অথই দৈরার নাইয়া

অথই দৈরার নাইয়া

নবকুমার দাস


মূল কাহিনী : রাইডার্স টু দা সি ।। মূল লেখক : জন মিলিংটন সিঞ্জ

প্রাককথন

‘অ্যারান আই ল্যান্ডস’ এবং ‘সাগর দ্বীপ’, এই দুটির মধ্যে মিল কোথায়?
আপাতত কোথাও মিল নেই। কোথায় পশ্চিম আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে উপসাগরের তীরের তিনটি ছোট্ট দ্বীপের দ্বীপমালা। গ্রামীণ ইয়োরোপের খণ্ডচিত্র। আর অধুনা গাঙ্গেয় পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণতম প্রান্তের দ্বীপখণ্ড যা মূল ভুখণ্ড ও বঙ্গ উপসাগরের মাঝের সংযোগ ভূমি, বিচ্ছিন্নতার দ্বীপও বলা যায়। সাগর দ্বীপ বৃহত্তর সুন্দরবনের একটি দ্বীপ হলেও বাঘের বসতি নেই অনেক বছর থেকে। যা কিনা নদীনালা বেষ্টিত সুন্দরবনের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে একটু স্বতন্ত্র। এই দ্বীপটি আয়তনে অ্যারান আই ল্যান্ডসের ছয়গুনের কাছাকাছি। কিন্তু কোথাও তো মিল আছেই, নইলে এই প্রশ্নটি অবান্তর।
দুটি দ্বীপের মধ্যে বাস্তবিক ভৌগলিক বা ঐতিহাসিক কোন সংযোগ নেই। কিন্তু আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে অদ্ভুত এক সাদৃশ্য আছে। পুরাণ মতে বিষ্ণুর অবতার কপিলমুনি সাগর দ্বীপে আশ্রম স্থাপন করেছিলেন এবং সাগররাজার শাপভ্রষ্ট ষাট হাজার পুত্রের অস্থি গঙ্গা দেবীর আবাহনে বিসর্জন দিয়েছিলেন মকরসংক্রান্তি বা সূর্যের উত্তরায়নের দিন। ভারতীয় উপমহাদেশের হেন হিন্দু নেই যারা সাগরে তীর্থ করতে আসেন না কিংবা আসার কথা ভাবেন না। বর্তমান ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহৎ তীর্থক্ষেত্র এই সাগর। সাগরমেলা এখন আন্তর্জাতিক।
একদা অরণ্যসংকুল নদী ও সাগরবেষ্টিত এই দ্বীপভূমি থেকে তীর্থের শেষে নৌকায় ফেরার পথ ধরেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর উপন্যাস ‘কপালকুন্ডলা’র সূত্রপাত হয়। কুন্ডলে বা মৃন্ময়ী, পদ্মাবতী বা মতিবিবি এবং নবকুমারের দোলাচলে এই দ্বীপের ভূমিকা যতসামান্য হলেও সূচনা এখান থেকেই। ঠিক তেমনি, কেল্টিক এবং খ্রিস্টীয় সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার অন্যতম পীঠস্থান এই অ্যারান আই ল্যান্ডস, পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ আদর করে বলেন অ্যারানস’। প্রাগৈতিহাসিক কালের সাতটি পাথরের দুর্গ আছে অ্যারানসের ইনিস মোরে, ডুন আওনঘসা। খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকের তৈরি। আইরিশ সাধু এন্ডা ৪৯০ খ্রিস্টাব্দে ইনিস মোরেতে একটি খ্রিস্টীয় আশ্রম কিলেয়ানি মনাস্ট্রি তৈরী করলেন। কালক্রমে তাই হয়ে উঠল সন্ন্যাস, করুণা ও চর্চার ভারকেন্দ্র। পশ্চিমা সাধুসন্তদের অনেকেই এখানে নিভৃতবাসে কাটিয়েছেন। আধ্যাত্মিকতার এক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল এই দ্বীপভূমি। লেখক শিল্পীরাও বাদ পড়েননি। লেখক বন্ধুদের পরামর্শে ১৮৯৮ সালে গরমের ছুটি কাটাতে এখানে এলেন সাহিত্যিক জন মিলিংটন সিঞ্জ। জায়গাটির প্রেমে পরে গেলেন। তারপরে, প্রায় প্রতিবছর তিনি গরমের ছুটি এখানেই কাটাতে শুরু করলেন। পরবর্তীকালে ১৯০৪ সালে প্রকাশিত “রাইডার্স টু দি সি” নাটক এবং ১৯০৭ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন “দি অ্যারান আই ল্যান্ডস”এর ছত্রে ছত্রে এই দ্বীপের কথা লিখলেন তিনি। তাঁর পরবর্তী ছয় ছয়টি নাটকের পটভূমি হয় এই দ্বীপ কিংবা এখানকার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ।
তা নয় হল, আপনি ভাবতে পারেন হঠাৎ এই প্রসঙ্গ আনার হেতু কি? হেতুটি নেহাৎ কাকতলীয়। ছাত্রজীবনে পড়া “রাইডার্স টু দি সি” নাটকটির আবেদন এখনো আচ্ছন্ন করে তোলে। সাম্প্রতিক ফগী ও আম্ফান – ধস্ত পরিস্থিতিতে নতুন করে পুরানো সেই একাঙ্ক নাটকটির কথা মনে পড়ল। প্রকৃতির কাছে কত তুচ্ছ মানুষ, তার জীবন ও জীবিকা কি অসহায় তা নতুন করে মনে করাল। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল জে এম সিঞ্জের এই নাটকটি অনুবাদ করব। কিন্তু বাংলার পটভূমিকায় প্রকাশের জন্যে অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটাতে হয়েছে। খ্রিস্টীয় ও কেল্টিক অনুষঙ্গের পরিবর্তে এই অনুবাদে আমি ব্যবহার করলাম স্থানীয় ও ইসলামীয় উপাদান। দোখনো ভাষা পুরোপুরি আয়ত্বে না থাকায় এক মিশ্র আঞ্চলিক বাংলা ব্যবহার করেছি কারণ, “অথই দৈরার নাইয়া” এই বাংলা অনুদিত নাটকের পটভূমি আমাদের সাগরদ্বীপ। সাগরদ্বীপে আমি প্রথম গেছিলাম ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। বিগত তিন বছরে বার ছয়েক গিয়ে সবমিলিয়ে প্রায় দেড় মাস থেকেছি। অবশ্য সাগরমেলার দায়িত্ব সামলাতেই যাওয়া। তবু রথ দেখা এবং কলা বেচার কাজ করতে ভুলিনি। দেখুন অনুবাদ অথবা আমার এই নবীকরণ আপনাদের কেমন লাগে।


পটভূমি : সাগর দ্বীপ

চরিত্র
মরিয়ম—বৃদ্ধা বেওয়া
বরকতুল্লা—তাঁর যুবক পুত্র
আফরিন—তাঁর যুবতী কন্যা
নওরিন—তাঁর কিশোরী কন্যা
গ্রামীণ জনতা

দৃশ্য – ১

(হোগলাপাতার রান্নাঘর, ভিতরে একটি মাছধরার জাল ঝুলছে, একখানি নৌকার পাল ভাঁজ করা আছে, একটা সুতো কাটার চড়কা, দেওয়ালে ঠেস দেওয়া কিছু কাঠের পাটা ইত্যাদি ঘরোয়া জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে।
আফরিন, বছর কুড়ির যুবতী, সবেমাত্র রুটি সেঁকা শেষ করে উনানের উপর থেকে তওয়া নামিয়ে একে একে রুটিগুলো পাত্রে গুছিয়ে রাখলো। এবার হাত ঝাড়ল তারপর ভালো করে হাত ধুলো এবং তারপর চড়কা ঘুরাতে শুরু করল।
নওরিন, বছর সতেরোর কিশোরী, রান্নাঘরের দরজা ঠেলে কোনোক্রমে মাথাটা গলাল)

নওরিন : (ফিসফিস কণ্ঠে) উনে কৈ?

আফরিন : শুইছে কই, আল্লায় জানেন ঘুমাইছে কি। ঘুম কি আইব? যদি পারে
তো ঘুমাক।

[নওরিন ধীরে ধীরে আফরিনের কাছে এগিয়ে এল, তারপর তার চাদরের নিচ থেকে একটা কাপড়ের পুঁটুলি বার করল]

আফরিন : [জোরে জোরে চড়কা ঘুরাতে ঘুরাতে] তর কাছে ওইডা কী?

নওরিন : ইমাম সাহেব এইগুলি দিছে। কইছে কি এইগুলান নামখানায় ডুইব্যা
যাওয়া নাইয়ার ছেঁড়া জামা আর লুঙ্গি ।

(আফরিন হটাৎ চড়কা ঘোরানো বন্ধ করে দেয়, কথাগুলো শোনার জন্যে নওরিনের দিকে ঝুঁকে পরে …)

নওরিন : বুবু, চল আমরা দুইজন মিইল্যা দেখি এইগুলান মকবুল ভাইয়ার
কিনা, মায়ে তো সাগরের ধারে ধারে একা একা ঘুইড়্যা ঘুইড়্যা হয়রান হৈয়া গ্যাছে।

আফরিন : কিন্তু এইগুলি মকবুল ভাইয়ার হয় ক্যামনে নওরিন? হ্যাথে তো মাছ
ধরতে গেছিল বকখালির দিকে! অতখানি উত্তুরে সে ভাইস্যা যায়
ক্যামনে?

নওরিন : অত কথা তো জানি না বুবু। নয়া মৌলবি কইছে এমন নাকি হয়, যদি
হাওয়ার টানে মকবুলভাই উত্তরদিকে ভাইস্যা গিয়া থাকে তো
হইলেও হইতে পারে। তাইলে, কবার লাগে কি আল্লা রসূল তারে
পানির তলে দাফন দিছে। আর এগুলান যদি তার না হয় তয়
আল্লাপাকে তারে কৈ যে না কৈ টাইন্যা লৈয়া গ্যাসে কেডায় জানে।
এবারে ক্যাইন্দা ক্যাইন্দা মা’জান নিজের এন্তেকাল ডাইক্যা আনবো
বুবু।

[যে দরজাখানি নওরিন অর্ধেক খুলে এসেছিল তা হঠাৎ হাওয়ায় পুরো খুলে গেল]

আফরিন : [উদ্বিগ্নভাবে সেদিকপানে চেয়ে] তুই কি মৌলবি সায়েবরে কৈছস যে
আইজ বরকতভাইয়ার গরুরহাটে যাওন থামন লাগে?

নওরিন : হুম, আমি কৈছিলাম কিন্তু উনে কইলেন, “থামাইয়ো না, আর ভয়
পাইয়ো না, তোমার মা-জান সারারাত জাইগ্যা আল্লারে ডাকব,
আল্লাপাক নিশ্চয় অরে দ্যাখবো। অর একডা পোলাও না রাইখ্যা তোমাগরে নিঃস্ব করব না…”

আফরিন : ঢেউসাগরে আজ সুমুদ্দুরের হালত কী, নওরিন?

নওরিন : মোডামুডি আছে, আল্লা জানে। দখিন দিক থিকা সুমুদ্দুর গর্জাইতাছে,
অহন কোটালে বাতাস চড়লে মারাত্মক হইয়া যাইব। (সে পুঁটুলিটাকে নিয়ে বাঁশ–বাখারির মাচার কাছে যায়) অহন কি পুঁটলি খুলুম?

আফরিন : আমাগো আলাপ শুইন্যা না উনে জাইগ্যা যায়! (মাচার কাছে যেতে
যেতে) দুইজনে কান্দিলে অনেক সময় লাগব।

নওরিন : (ভিতরের দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজায় কান পাতে) বিছ্নায়
নড়তাছে। মনে হয় মা এহনি চইল্যা আইব।

আফরিন : মইটা দে তো, ঘুঁটের ভিতরে পুঁটলি লুকাই রাখুম, উনে জানবেই
না কই রাখছি, আর দখিন থিক্যা জোয়ারে কি ভাইস্যা আসে হেইডা দেখনের লাইগ্যা উনে গাঙের ধারে যাইব, তহন দেখুম। (নওরিন জমা করে রাখা জ্বালানির কাঠগোলার গায়ে বাঁশের ছোট একটা হালকা মই হেলান দিয়ে রাখে, আফরিন কয়েক ধাপ ওঠে এবং পুঁটুলিটাকে ঘুঁটের ভিতর লুকিয়ে রাখে। আলুথালু বেশে ভিতরের ঘর থেকে মরিয়ম বেরিয়ে আসে।)

মরিয়ম : (আফরিনের দিকে নজর পড়ে এবং কৌতূহলী হয়ে বলেন) উপরে
উঠছস ক্যান, দুফুর-রাইতের মত জ্বালন নেই?

আফরিন : এট্টু আগে শুঁটকি মাছ বসাইছি। (কয়েকটা ঘুঁটে নিচে ছুঁড়ে দেয়)
আর বরকত ভাইয়া জোয়ার আইলে কচুবেড়ে যাইবে কয়, তাড়া আছে। (নওরিন ঘুঁটেটা নিয়ে চাটুবাটির চারপাশ দিয়ে উনুনের ভিতর গুঁজে দেয়)

মরিয়ম : (উনুনের পাশে একটা পিঁড়ি টেনে বসেন) না, ও আজ যাইব না, পুব-দখিন থেকে ঝড় উঠতাছে। নয়া ইমাম ওরে অবশ্যই আটকাইব, আইজ অন্তত বরকতইয়া যাইব না।

নওরিন : মাজান, ইমামসাহেব কইছে বাধা দিবে না আর আমি শুনছি রহিমুদ্দি
ভাই, কমল লস্কর আর কালু নস্করও বরকতভাইয়ার লগে যাইবে।

মরিয়ম : কিন্তু ও কই আছে এহন?

নওরিন : ভাইয়া অহন কোনো নৌকা কচুবেড়ে যাইতাছে কি জানবার লগে
গাঙের দিকে গ্যাছে, মাজান মনে হইতাছে ভাইয়া বেশিক্ষন থাকব না, আসলে আসমানের অবস্থা ভালা না, গাঙের পানিও ঘুরতাছে।

আফরিন : কেডায় আইতাছে, বনবিবির থান পাড় হইল, পায়ের শব্দ শুনা যায়।

নওরিন : (বাইরের দিকে চেয়ে) হ, ঠিক কৈছো বুবু, ভাইয়া আইতাছে, খুব
তাড়ায় আছে লাগতাছে।

বরকতউল্লা : (ভিতরে ঢুকল এবং ঘরের ভিতরটা দেখল। খুবই মনমরা হয়ে
ধীরে ধীরে কথা বলল) নতুন দড়ির টুকরাটা, কচুবেড়িয়া থেকে কিনছিলাম যেইডা, সেইডা কই, আফরিন জানোস?

আফরিন : (নেমে এসে) নওরিন, এইডা ওরে দে তো, ওইডা দিয়া বিহানবেলায়
কালা বকনা বাছুরটারে বাঁধছি আমি। এইডা পুরান নাওয়ের দড়ি।

নওরিন : (দড়িটা দিতে দিতে) এইডা ঠিক হইব তো ভাইয়া?

মরিয়ম : বরকত, এই দড়িটা ছাইড়্যা রাখ বাপ। কাফনের লগে ঝুলাইয়া রাখ।
(বরকত দড়িটি নিল) আমি কইতাছি ওই দড়িখান এইখানে লাগব, যদি মকবুল কাল সক্কালে, কিংবা পরশু, কিংবা এই হপ্তার কোনো সক্কালে ভাইস্যা আসে, আল্লার রহমতে আমরা ওর লাইগ্যা একখান বড় কাফন বানামু।
বরকত : [দড়িটি পাকাতে পাকাতে] না, না দেরি করন যাইব না। আমারে
তাড়াতড়ি বাড়াইতে লাগব। নাও ছাইড়া যাইব। আমি শুনছি এবারে বকরির হাট জমছে। আমাগো গরু বিক্কিরি হইব হয়তো।

মরিয়ম : কিন্তু ওরা কৈছিল কি মকবুল যদি ভাইস্যা আসে আর বাড়িত কোন
পুরুষ মানুষ না থাহে তহন কেডায় কাফন বানাইব। তুই তো জানোস কচুবেড়ে থেইক্যা অনেক দাম দিয়া দাফনের কাপড় আর কাফনের পাডাগুলি কিনছি।

(মরিয়ম কাঠের পাটাগুলি দেখছেন)

বরকত : আরে দেখতাছ, ক্যামনে ভাইস্যা আইব শুনি? আরে গত নয় দিন
ধইরা রোজ রোজ দেখতাছি, তার উপর দক্ষিণ পশ্চিম দিক থিকা জোড়ে বাতাস বইতাছে।

মরিয়ম : অরে যদি আর না খুঁইজ্যা পাওন যায়! কোন গহীন দৈরা থিক্যা ঝড়
উঠতাছে, রাইতের আসমানে চাঁদ তারা দেখতাছে। রাইতের পর রাইত সেই বাতাস বাইরা ঝড় হইতাছে। অহন একখান পোলার দাম একডা বকরা? একশো খান বকরি কিংবা এক হাজার খান বকরি দিয়াও আমার কী হইব যদি একখান পোলাও না থাকে?

বরকত : (দড়ি দিয়ে গল বন্ধনী তৈরি করতে করতে, আফরিনের উদ্দেশ্যে)
তয় জমিনের কাছে গিয়া দেখবি ভেড়াগুলি লাফাইয়া সর্ষে ক্ষেতে নামতাছে কিনা, আর যদি কসাই আসে তইলে ভালো দাম পাইলে কালা পাওয়ের ভেড়াটারে বেইচ্যা দিস।

মরিয়ম : আরে, ও ক্যামনে ভেড়ার দাম ভালো কি মন্দ বুঝব?

বরকত : (আফরিনের উদ্দ্যশ্যে) পশ্চিমা ঝড় যদি শ্যাষ পর্যন্ত চলতেই থাহে
তইলে তুই আর নওরিন মোরগাটারে বেইচ্যা দিস।
মরিয়ম : আজ থিক্যা এই সংসারে থাহা কঠিন হইল। এই পরিবারের সব
রোজগেরে মানুষ একের পরে একে ডুইব্যা মরছে। তর যদি কিছু হইয়া যায় তহন আমি এই দুই মাইয়া লইয়া ক্যামনে বাঁচুম? আমার নিজেরই তো কবরে যাওয়ার সময় ঘনাইছে।

(বরকত দড়ির গলবন্ধটি নামিয়ে রেখে নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে নেয়)

বরকত : (নওরিনের উদ্দেশ্যে) দেখতো নৌকা আইলো নাকি?

নওরিন : (বাইরে তাকায়) ভাইয়া নৌকাখানা অনেক দূরে দেখা যাইতাছে,
পাল নামাইয়া আইতাছে।

বরকত : (তার থলে আর খৈনির ডিবে নিতে নিতে) আমি অখন বারামু
তারপর মনলাগে পরশু দিন ফিরুম, বাতাস খারাপ থাকলে তরশু কিংবা আরো পরে ফিরুম। সবই খোদার মর্জি।

মরিয়ম : (উনুনের দিকে সরে এলেন এবং চাদরখানি দিয়ে মাথা ঢাকলেন)
বাপ্ এইডা কি করতাছস? তরে আমি যাইতে না কৈছি তাই আমার
লগে কথা কইতাছস না, কি কঠিন আর নিষ্ঠুর হইয়াগেছস। এই
জোয়ান বয়সে তোর মত নাইয়া তো নাও লইয়া দৈরায় যাইব কিন্তু
আমাগো মত বুড়ি মায়ের নিষেধ কেডায় শুনবো?

বরকত : (গলারদড়িটি নিয়ে) আমারে এখনই যাইতে হইবে। কালা গরুটারে
লইয়া আগামু আর পিছে পিছে ধলা গরুটা যাইবে। আল্লায় তোমাগরে দোয়া করবেন।

(সে বেরিয়ে গেল)

মরিয়ম : (সে দরজার কাছে পৌঁছাতেই কাঁদতে শুরু করলেন) পোলায়
চইল্যা গেল। খোদাতালা আমাগোরে দেইখ্যো, ওরে আবার দেখুম কিনা ঠিক নেই। শবেবরাতের রাতে চেরাগ জ্বালানোর লাইগ্যা এই দুনিয়ায় আমার আর কোনো পোলায় থাকব কিনা তা আল্লায় জানে!
আফরিন : মা, তুমি ভাইজানরে দোয়া করবা না? দেহো যাওনের সময় ভাইয়া
দরজার দিকে চাইতেছিল। তুমি দোয়া করলা না, অর খারাপ
লাগব না? মা তোমার দোয়া ছাড়া ভাইয়ার বাইরে যাওন আমাগো
বাড়ির লগে ভালা না। ওরে আজাইরা কথাগুলান না শুনাইলেই
ভালা হইত।

মরিয়ম : (কোন দিকে না তাকিয়ে সাঁড়াশিটা তুলে নিয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে
উনানের ভিতর আগুনটাকে ঝাঁকিয়ে দিতে থাকে।)

নওরিন : (তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল) আরে তুমি তো রান্না থিকা আগুন সরাই
লইতাছ।

আফরিন : (কাঁদতে শুরু করে) খোদা আমাগরে মাফ কইরা দ্যান, ভাইয়ারে
খাবার দিতেই ভুইল্যাগেছি।

(সে উনানের কাছে এগিয়ে আসে)

নওরিন : আরে খাবারটা তো পুইড়্যা গেছে, সূয্যি ডুইব্যা যাওনের পর আজ
রাত্রে ভাইয়া কিচ্ছু খাইতে পাইবো না।

আফরিন : (উনুন থেকে রান্নাটি সড়িয়ে নিতে নিতে) এইটা পুইড়্যা গেছে,
ভাইয়ার না জানি কিছু হয়। আরে এই বাড়িতে বুড়া মায়ে এত্ত যে বারণ করে, কিন্তু কেউ তার কথা শোনে না।

মরিয়ম : উঁচু পিঁড়ির উপর বসে সামনে পিছনে দুলতে থাকে)

আফরিন : (রান্নার কিছুটা অংশ একটা পাত্রে ঢেলে নিয়ে সেটাকে কাপড়
দিয়ে মুড়ে দিল, তারপর মরিয়মের উদ্দেশ্যে এগিয়ে দেয়।)
মাজান, তুমি এইটারে লইয়া যাও, নদীর ধারে খাড়াও, ভাইয়ারে
দিয়া আসো। অরে খাবারটা দিবা আর আল্লারে ওর ভাল করতে
কবা। খারাপ কথা মিছা হইয়া যাইব। ওর মনডাও ভালা হইব।
মরিয়ম : (খাবারটি নিল) কিন্তু আমি কি ওর মত এত তাড়াতাড়ি যাইতে পারুম?

আফরিন : অহনি বাড়াও, ধরতে পারবা।

মরিয়ম : (কোনক্রমে কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়ালেন) আমি হাঁটতে পারতাছি না।

আফরিন : (উদ্বিগ্নভাবে তার দিকে তাকাল) নওরিন, মা রে একখান লাডি দে,
পা হড়কাই যাইব নইলে।

নওরিন : কোন লাডি দিমু?

আফরিন : সেই লাডিখান যেইডা মকবুল ভাইয়া কচুবেড়ে ঠিকণ আনছিল।

মরিয়ম : (নওরিনের হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে) ও আল্লারে, এত বড় দুনিয়ায়
বুড়া মানষে তাগো পোলাপাইনের লাইগ্যা জিনিসপত্র রাইখ্যা যায়, আর আমার কপাল দেহো, পোলা-পাইনে আমারে আরো বুড়া হওনের লাইগ্যা তাগো জিনিসপত্র ছাইড়া যায়।

(তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন, মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেলেন)
(নওরিন মইয়ের উপর উঠতে থাকে)

আফরিন : খাড়া, নওরিন। মনে হইতাছে কি মাজান আবার ফিরে আইতে
পারে। মাজানের মনে এত্ত কষ্ট, খোদা যেন মাজানরে শান্তি দ্যান অস্ফুট কন্ঠে)। তুই বুঝবি না, মাজান না কি কইরা বসে।

নওরিন : বুবু মাজান কি ঝাউবনের আড়ালে চইল্যা গেছে?

আফরিন : (গলা উঁচিয়ে দেখতে থাকে) অহন চইল্যা গেছে। তাড়াতাড়ি
নামাইয়া ফ্যাল, এক্ষুনি হয়তো ফিরে আইব। আল্লায় জানে আবার কখন বাড়াইব।

নওরিন : (ঘুঁটের গাদা থেকে পুঁটলিটাকে টেনে বার করল) নয়া মৌলবি কইছেন
যে উনি কাল আইবেন, তহন কহন লাগব এইগুলান মকবুল ভাইয়ার না অন্য কারো।

আফরিন : (পুঁটলিটিকে নিয়ে) উনে এইগুলান কই পাইছেন সেইডা কি কইছেন?

নওরিন : (নেমে এসে) বুবু উনে কইছেন, দুইডা লোক ছিল, ওঁরা মাছ ধইরা
ফিরতেছিল। খুব ভোর বেলায়, তহনও মোরগায় চিল্লায় নি, তয় কি ঝড় উঠছিল। মাঝ দৈরায় ছিল নাকি, হাল দিয়া সামলাইতে পারে নাই, তাগো নাওখানি নামখানা যাওনের পথে ডুইব্যা গেছে।

আফরিন : (পুঁটলিটিকে খোলার চেষ্টা করতে করতে) আমারে একখান ছুরি
দে তো নওরিন। লোনাজলে দড়িগুলান আঁইট্যা গেছে। আর একখান কালা গিঁট দিছে যেইখান খুলতে পুরা সাত দিন লাগব।

নওরিন : (একখানি ছুরি দিল) আমি শুনছি সাগর থিক্যা ডায়মন্ড যাইতে
অনেক সময় লাগে।

আফরিন : (পুঁটলি বাঁধা দড়িগুলিকে কাটতে কাটতে) ঠিক শুনছস। এই
ছুরিটা যে লোকটা বিক্রি করছিল, সেই লোকটার বাড়ি ডায়মন্ড। উনি কইছিল হাঁইট্যা গ্যালে দুইদিন লাগব।

নওরিন : আচ্ছা তাইলে, ভাইস্যা যাইতে কতডি সময় লাগব?

আফরিন : (পুঁটলিটিকে খুলে এক টুকরো কাপড় বার করে, দুজনেই সেটা
গভীর মনযোগ দিয়ে দেখতে থাকে) আল্লায় আমাগো রক্ষা করেন নওরিন, দক্ষিণ রায় আমাগো রক্ষা করেন, বনবিবি আমাগো রক্ষা করেন (নিচু গলায় বলল)। এই গুলান যেন মকবুল ভাইয়ার না হয়। দেখতো এইখান কি মকবুল ভাইয়ার জামা?

নওরিন : আচ্ছা বুবু, আমি মকবুল ভাইয়ার জামাগুলি দেখতাছি (ঘরের
কোনায় ঝুলতে থাকা কিছু জামাকাপড় দেখতে থাকে সে)। না বুজান এই রকম জামাখানা তো এই খানে নেই। তাইলে কই যাইব সেইডা?

আফরিন : আমার মনে হইতাছে বরকতাইয়া ঠিক এই রকম একখান জামা
আজ সকালে পরছে। হুম, ওর নিজের জামাখান ভিইজ্যা গেছিল তাই। (ঘরের আরেক কোনে হাত দেখিয়ে বলল) ওই দেখ ভিজা জামাখানা মেইল্যা দিছে। দুইডা জিনিস একই কাপড়ের তৈরী। আইন্যা দে মিলাইয়া দেখি।

(নওরিন জামাটিকে নিয়ে আসে আফরিন সেটার সঙ্গে পুঁটলির জামার টুকরোটাকে মিলিয়ে দেখতে থাকে)

আফরিন : দুইডা একই জিনিস নওরিন, কিন্তু ডায়মন্ড হারবারের বাজারে কি
একইরকম জামা দুইখান বিক্রি হয় না? অন্য কোনলোকে কি ঠিক এই রকম কাপড়ের জামা কেনেনি? মকবুল ভাইয়া যেইরকম কাপড়ের জামা কিনছিল হয়ত ঐরকম জামা অন্য লোকেও কিনছিল। (এবারে একখানি মোজা বার করে দেখে, মোজার সেলাইগুলো আঙ্গুল ছুঁয়ে দেখতে দেখতে সে ডুকরে কেঁদে ওঠে) এইডা মকবুল, এইডা মকবুল ভাইয়া; আল্লায় ওরে বাঁচাইছে। কিন্তু আমি মাজানরে কি কমু? বরকতাইয়া নিশ্চয় অহন মাঝ দৈরায়? মাজানরে কেমনে বুঝামু? এই মুজা মকবুল ভাইয়ার।

নওরিন : ঠিক কইছ বুজান, আমি যে তিন জোড়া মোজা সিলাইছিলাম এইডা
তার মাঝেরডা। এই নকশাটা দেখ, তিন কাঁটা সেলাইয়ের পর চার ঘর বাদ দিয়া আবার তিন কাঁটা কইরা সিলাইছিলাম।

আফরিন : (সেলাই গুনতে থাকে) হুম, বইন ঠিক কইছস, এক্কেরে ঠিক
কইছস। (উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে) তুই যা কৈলি, এর লগে সিলাই মিল্যা যাইতাছে। আহঃ নওরিন, ভাইয়া মইরাও শান্তি পায়নি। সমুদ্দরের পানিতে ভাসতে ভাসতে, দুলতে দুলতে কিনা গেছে। মরা মানষের অসার শরীলডা দেইখ্যা শকুন উড়ছে আসমানে। কে জানে হয়ত ছিঁড়ে খাইছে তারে।

নওরিন : (দুলে দুলে কাঁদতে থাকে, বহু দুটি দিয়ে সামনে থাকা কাপড় চোপড়
নাড়াচাড়া করতে থাকে) এতো বড় নাইয়া, এত ভালো মাছুয়ার কপালে এমনডাই লেখছিল আল্লা! মরনের সময় ওর পরনে একখান পুরান, ছেঁড়া জামা আর একজোড়া মোজা ছাড়া আর কিচ্ছু রইল না।

আফরিন : (একটু থমকে গিয়ে) নৌরি, মন লাগে, মাজান আইতাছে, দেইখ্যাক
তো। পদের মধ্যি আওনের শব্দ শুনতাছি লাগে।

নওরিন : (বাইরের দিকে দৃষ্টি ফেরালো), ঠিক কইছ বুবু, মাজান বেবাক
ঘরের দুয়ারে চইল্যা আইছে।

আফরিন : ঠিক আছে, মায়ে ঘরত ঢুকার আগে এই গুলান গুটায়া ফ্যালতে
লাগব। লাগতাছে বরকতাইয়াকে দোয়া দেওনে বেশি সময় লাগেনি। আর একটা কথা, আমরা যা যা জানছি অখন বলা যাইব না।

নওরিন : (পুঁটলিটাকে গোছানোর জন্য আফরিনকে সাহায্য করে) অহন এইডা
আমরা ঘরের ওই কোনাডায় রাইখ্যা দিমু। (পুঁটলিটাকে ওরা দুজনে ঘরের অন্য কোনায়, তোলা উনুনের পাশে লুকিয়ে ফেলল। আফরিন আবার তার নিজের চড়কার কাছে ফিরে এল।)

নওরিন : আমারে দেইখ্যা কি মনে হইতাছে যে আমি কানতেছিলাম?

আফরিন : তুই দরজার দিকে পিছ কইরাব, তর মুখে আলো পড়ব না, মায়
দ্যাখতে পাব না।

(দরজার দিকে পিছন করে নওরিন তোলা উনুনের কাছে একটা জল চৌকির উপর বসে। মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে মরিয়ম খুব ধীরে ধীরে ঘরের অন্যপ্রান্তে রাখা আরেকটা জল চৌকির উপর গিয়ে বসে। বরকতের জন্যে দেওয়া খাবারের পুঁটুলিটা এখনো তার হাতে ধরা আছে। আফরিন ও নওরিন একে অন্যের দিকে তাকায়, নওরিন ইশারায় খাবারের পুঁটলিটাকে দেখায়।)
আফরিন : (একবার চড়কা ঘুরিয়ে) মাজান, খবরটা ভাইয়ারে দেওনি?

(মরিয়ম ডাইনে বাঁয়ে না ঘুরে ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঝুঁকতে থাকে)

আফরিন : তুমি অরে যাইতে দেখছ?

(মরিয়ম আরো ঝুঁকতে থাকেন)

আফরিন : (কিছুটা অধৈর্য হয়ে) আল্লায় তোমায় মাফ করুন; কানতাছে ক্যান?
একটু গলা উঁচাইয়া কওতো কি হইছে? কি দ্যাখছ তুমি? বরকত ভাইয়ার দেখা পাইছ? মা আমি তোমার লগে কথা কইতাছি। সাড়া দাও।

মরিয়ম : (দুর্বল কণ্ঠে) আমার কলিজা পুইড়া গেছেরে মা।

আফরিন : (আগের মত) বরকত ভাইয়ার লগে দেখা হইছে?

মরিয়ম : আমি একটা ভয়ঙ্কর জিনিস দেখছি।

আফরিন : (চড়কা ছেড়ে তার দিকে এগিয়ে গেল, এবং ভালো করে খেয়াল
করল) আল্লায় তোমায় মাফ করুন; কালা আর ধলা এই গাই দুইখান লইয়া বরকত ভাই অহন অনেক দূরে আগাইয়া গ্যাছে।

মরিয়ম : (কিছু একটা বলতে গেলেন, কিন্তু মাথা থেকে চাদরখানি খুলে
পড়ল, তার পাকা চুলের রাশি দেখা গেল। ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে তিনি বলা শুরু করলেন।) কালা গাইটা ওর পিছে…

আফরিন : (আগুনের কাছে পৌঁছে) তোমার কি হৈছে কওতো?

মরিয়ম : (খুব ধীরে ধীরে বলতে থাকেন) আমি খুব খুব ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন
দেখছি, ইবন শিরিন জানেন এর মানে কি? কঠিন এক দুঃস্বপ্ন দেখছি আমি।
আফরিন ও নওরিন : (এক সাথে বিস্মিত ও ভয় পেয়ে) কি কইতাছ!

(তারা দুইজনে তাদের মায়ের সামনে গিয়ে বসল)

নওরিন : আমাগো কও কী দেখছ।

মরিয়ম : আমি বনবিবির থান পাড়াইয়া যাইতেছিলাম, মনে মনে আল্লারে
ডাকতেছিলাম। তহন বরকতাইয়া ধলা গরুর পিঠে চাইপ্যা আইল, পিছে পিছে কালা গরুটা আইতাছে (দুই হাত দিয়ে তিনি যেন কিছু একটা আড়াল করতে চাইছেন) আর ওইডার পিঠের উপর, ওইডার পিঠের উপর সে বইয়া রইছে… খোদা তাল্লা আমাগো বাঁচান!

আফরিন : ওইডার পিঠের উপরে তুমি কারে দেখছ?

মরিয়ম : দেখছি মকবুইল্যা বইয়া রইছে।

আফরিন : (কোমল কন্ঠে বলল) মাজান, তুমি ভুল দেখছ, ওইডা মকবুল
ভাইয়া না, ও আরো অনেক উত্তরপানে ভাইস্যা গেছে, আল্লায় অরে অতল দৈরার পানিতে দাফন দিছে।

মরিয়ম : (একটু দৃঢ়তার সঙ্গে) না আমি ঠিক দেখছি, ও লাফাইতে লাফাইতে
আইতেছিল। পেথ্থমে ধলা গরুটায় চাইপ্যা বরকতাইয়া আইল, আমি কওনের চেষ্টা করলাম, “বাপ, আল্লায় তর ভালা করুক, আল্লা রসুল রহমানে রহিম” কিন্তু কেউ যেন আমার গলা চাইপ্যা ধরল ও কইল, “আল্লা তোমার ভাল করুক”, তারপর ও তাড়াতাড়ি চইল্যা গেল, আমি কিচ্ছুটি কইতে পারলাম না। আমি তহন ভালো কইরা চাইয়া দেখলাম, দেখলাম কালাগাভির উপরে মকবুল বইয়া আছে, কি সোন্দর জামা পড়ছে! পায়ে নতুন জুতা পড়ছে! দেইখ্যা চিনাই যাইতাছে না, আমি অরে দেইখ্যা কানতেছিলাম।

আফরিন : (হাঁটুমুড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসতে শুরু করে) ও আল্লারে, কি
কইতাছ, ওরে নৌরিরে আমাগো সব গ্যাছে, সবকিছু চইল্যা যাইতাছে, কিচ্ছুডি বুঝতাছস না! আমাগো কষ্টের দিন শুরু হইল।

নওরিন : নয়া মৌলবি কৈছে না আল্লা রসুল মায়েরে আর পোলার কষ্ট দিব না?

মরিয়ম : (গলার স্বর নামিয়ে, কিন্তু আন্তরিকভাবে বলল) হ, সাগর, দৈরারে
ওর চাইয়া আর কেউ ভালা জানে না। … অহন বরকতাইয়ার পালা, অর এন্তেকাল ঘনাইতেছে রে, তরা মন্তাজুল মিঞারে ডাক দে, সাদা কাডের পাডাগুলি দিয়া ভালো কইরা কফিন বানাতে কইস, অগো যাওনের পরে তো আর আমি বাঁচুম না। একদিন এই বুড়ি বেওয়ার সোয়ামি আছিল, সোয়ামির বাপ আছিল, ছয় ছয়টা ছাওয়াল আছিল, এই বাড়িতে ছয়টা সুন্দর মরদ মানুষ আছিল। কত্ত কষ্ট কইরা অগোরে একে একে জন্ম দিছিলাম, এই দুনিয়ার আলো বাতাস দেখাইছিলাম, তাগো কাউরে খুঁইজ্যা পাওন গ্যাছে, কাউরে পাওন যায়নি। ওরা হক্কলেই অন্য অনেকের লগে হারায় গ্যাছে … বড় পোলা আছিল ইসমাইল, মাইজ্যা পোলা আছিল সেলিম, ওরা দুইজন বড় ঝড়ে হারাইছি … অথই দৈরার পানিতে ডুইব্যা গ্যাছে… দেখছস ওই দুয়ার দিয়ায় ওরা দুইভাই বাহির হইয়া মাছ ধরতে গেছিল…
(তিনি এক মুহূর্ত থামলেন, মেয়েরা তাদের পেছনে আধখানা খোলা দরজা দিয়ে কিছু শব্দ শুনতে পেল যেন)

নওরিন : (ফিসফিস করে বলল) বুজান কিছু শুনতে পাইতাছ? উত্তর পুব
দিক থিকা কিছু শুনা যাইতাছে।

আফরিন : হ, সমুদ্দের পাড়ে গোলমাল শোনা যাইতাছে …

মরিয়ম : (কোন কিছু না শুনেই বলতে থাকেন) সালাম আর অর বাপ, ওর
নিজের বাপ নিকষ কালো রাইতের আন্ধারে ডুইব্যা গেল, বিহানবেলায় সূয্যি উঠলে অগো কোনো চিন্ন খুঁইজ্যা পাওয়া গেল না, একখান লাডি কিংবা পালের টুকরাও না। এরপর সাদেকুল্লা ডুইব্যা মরল, মাঝ সুমুদ্দুরে ওর নাও উল্টায় গেছিল, আমি এইখানে হারুনরে কোলে লইয়া বইয়া ছিলাম, হারুন তহন দুধের শিশু, দুই হাঁটুর মাঝে কোল পাইত্যা ওরে আদর করতে ছিলাম, দেখলাম দুইজন, না তিনজন, না চারজন মাইয়া লোক আইল, বউ ঝি হইব, অরা আরো আগাইয়া আইল কিন্তু কেউ কথা কইল না। আমি চাইয়া চাইয়া বেবাক দেখলাম তাগো পিছনে এবারে মরদ লোকে আসতাছে, ওগো হাতে নৌকার খয়েরি রঙের বাদাম, হ্যাথে কিছু যেন জড়ানো আছে, পানি টপটপাইতাছে, দিনটা শুকনাই ছিল কিন্তু পানিতে সব ভিইজ্যা গেল। নওরিন, দোর পর্যন্ত পানির দাগ পইরা গ্যাছে।
(তিনি আরেক মুহূর্ত থামলেন, দরজার দিকে দুই হাত বাড়ালেন, দরজাটি ধীরে ধীরে খুলে গেল, বৃদ্ধা বিধবা মহিলারা একে একে প্রবেশ করতে থাকলেন, মৃত মানুষকে সন্মান জানানোর ভঙ্গিমা করলেন সবাই, মঞ্চের সামনে সবাই হাঁটু গেড়ে বসলেন, তাঁদের সবার মাথায় লাল রঙের বোরখা।)

মরিয়ম : (যেন স্বপ্নাবিষ্ট) এ কে? সাদেক? মকবুল? না অন্য কেউ?

আফরিন : মকবুলরে এখন থিক্যা অনেক দূরে অনেক উত্তরে পাওয়া গ্যাছে,
ওরে এখানে ক্যামনে দেখতে পাইবা?

মরিয়ম : জোয়ান মরদের অনেক ক্ষমতা, সারা দরিয়া চৈষ্যা বেড়ায়, এরা
কেমনে জানবো? মকবুইল্যা থাকলে কইতে পারতো, কিংবা ওর মতো অন্য কোন জোয়ান মরদ ঘরে থাকতো বুঝাইয়া কইতো, আরে ল শুন, ঝড়ের সময় মাঝ দরিয়ায় ভাইস্যা গিয়া একা নাইয়া যখন দিনের পর দিন পানিতে ডুবতে থাকে, ঢেউয়ের তালে উঠতে থাকে, নামতে থাকে তহন তারে কেডায় চিনব? নিজের মাও তারে চিনতে না পারে।

আফরিন : এইডা মকবুল ভাই, আল্লা অরে রক্ষা করেন, ওরা অর জামা
কাপড় পাঠাইছে, অনেক উত্তর দিক থিকা।

(সে কাপড়ের পুঁটলিটা এগিয়ে গিয়ে মরিয়মের হাতে তুলে দেয়। মরিয়ম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, নিজের হাতে সেগুলো নিল। নওরিন দেখতে থাকে।)
নওরিন : ওরা কিছু একটা বইয়া আনতাছে, ঐডা থিক্যা ফোঁটা ফোঁটা পানি
ঝড়তাছে, জমিনে দাগ পইড়্যা গ্যাছে।

আফরিন : (আগন্তুক মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলল) এইডা কি বরকত ভাই?
ঠিক কি? হুম, তাই তো মনে হইতাছে। হে আল্লা ওরে বাঁচান!

(দুইজন কম বয়সী মহিলা এগিয়ে এলেন এবং একটা খাট সাজিয়ে দিল। কয়েকজন জোয়ান লোক এসে বরকতের মৃতদেহ সেখানে রাখল। তার শরীরটা নৌকার পাল দিয়ে ঢাকা।)

আফরিন : (মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলল) ক্যামনে ডুবছে ও?

একজন মহিলা : কালা গাইটা ওরে গুঁতাইয়া পানিতে ফালায়দিছে। ঘূর্ণি পানিতে
ডুইব্যা লগে লগে ইন্তেকাল হৈছে।

(মরিয়ম একটু এগিয়ে গিয়ে খাটিয়ার সামনে ঝুঁকে পরে। মহিলারা দুলতে থাকে। আফরিন ও নওরিন খাটিয়ার অন্যপ্রান্ত ধরে হাঁটুমুড়ে বসে। পুরুষেরা দরজার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে।)

মরিয়ম : (তাঁর নিজের মাথাটিকে তুললেন এবং আশেপাশে কেউ আছে
কিনা সেইসব অগ্রাহ্য করে বললেন) যাউক, অহন ওরা সক্কলে চইল্যা গ্যাছে, দরিয়া আমার আর কিচ্ছু করতে পারবে না… দখিন দিক ঠিক যখন ঝড় বইয়া আসব আর আল্লারে ডাকতে লাগব না, দোয়া চাইতে লাগবে না, পুবদিক ঠিক বান ডাকলেও আমি নিশ্চিন্তি থাকুম, পশ্চিমে মেঘ উঠলেও আমার আর ভাবনা নেই। বাজ পড়লেও আমার আর কষ্ট থাকব না। গাঙের ধারে গিয়া আর পোলাপাইনের নাম ধইরা ডাকতে হইব না, পানিপড়া লাগব না, পীরের থানে যাইতে হইব না। অন্য মেয়ে বউরা যখন কানবো আমি আর কান্দুম না। (নওরিনের উদ্দেশ্যে বললেন) পাকের পানি আইন্যা দে রে মা, ঘুটিয়ারি শরীফের পানি আছে দেখ কই।

(নওরিন ঘরের এক কোন থেকে পবিত্র জল এনে দেয়)
মরিয়ম : (মকবুলের জামা-কাপড়গুলো বরকতের পায়ের কাছে রাখলেন।
তারপর মৃতদেহের উপর পবিত্র জল ছিটিয়ে দিলেন) বরকতাইয়া, এমনডা নয় যে তোর লাইগ্যা আমি আল্লার কাছে দোয়া মাঙিনি বাপ, মিশকালো আঁধার রাইতে তোর লাইগ্যা দুই চক্ষের পাতা এক করছি, কিন্তু আল্লায় তোরে কাছে টাইন্যা নিছে। অহন আমার পরম শান্তি, বিশ্রাম করুম কেবল। আমার অহন অনেক সময়, শীতের রাইতগুলানে বেবাক ঘুমামু। এক দানা খানাপানি হইলেই চলব, একটুকরা রুটি কিংবা একটুকরা মাছ হইলে হয়, না হইলেও চলব।

(তিনি আরেকবার হাঁটুমুড়ে বসলেন, শ্বাস বন্ধ করে প্রার্থনা করলেন)

আফরিন : (একজন বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে বলল) চাচা দিনের আলো ফুটলে
আপনে ও মন্তাজুল মিঞা মিল্যা একখানি কাফন বানাইতে পারবেন? ভালা দেইখ্যা সাদা কাড আনছিল ভাইয়া, ওইহানে আছে দ্যাহেন। ভাবছিল মকবুল ভাইয়ারে খুঁইজ্যা পাওন যাইব। ওর দাফনের লাইগ্যা এইগুলি কামে লাগব। চিন্তা করবেন না, কাম করনের সময় আপনাগো খাবার আমি বানাইয়া দিমু।

বৃদ্ধ মানুষটি : (কাঠের পাটাগুলি দেখে) ওইগুলির লগে কি পেরেক আছে?

আফরিন : না পেরেক তো নেই চাচা। পেরেক লাগব সেইটা তো বুঝিনি।

আরেকটি লোক : কী অবাক কান্ড! কাফন বানাইতে পেরেকের দরকার
আছে সেইডাই বুঝে নাই! এতদিন ধইরা এতগুলান কাফন দেখছেন, তাও জানে না!

আফরিন : চাচাজান মাজানের বয়স হইছে, মন ভাইঙ্গা গেছে, এতকিছু মনে
থাকে না।

(খুব ধীরে ধীরে মরিয়ম উঠে দাঁড়ালেন, মকবুলের জামা-কাপড়গুলো বরকতের মরটি দেহের উপর ছড়িয়ে দিলেন, তার উপর পবিত্র জলের শেষ বিন্দুটাও ছিটিয়ে দিলেন।)
নওরিন : (ফিসফিস করে আফরিনকে বলল) বুজান দেখছ, আইজ মাজান
কী রকম শান্ত আর স্বাভাবিক রইছে। মকবুল ভাইয়ার ডুইব্যা যাওনের খবর শুনিয়া কেমন কানছিল শুনছিলা? এক মাইল দূরের পীরের থান থিক্যা কাঁদনের শব্দ শুনা যাইতেছিল। মনে হয় মকবুলরে মায় বেশি ভালবাসত।

আফরিন : (ধীরে ধীরে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল) একজন বুড়া মানসে আর কতডি
পারে? গত নয় নয়ডা দিন ধরিয়া সমানে কানতাছে, আল্লারে ডাকতাছে। আর কত পারে? কানতে কানতে পুরা পাড়াটারে তো বিষাদপুরি বানাই ফ্যালছে।

মরিয়ম : (পবিত্র জলের খালি পাত্রটিকে উবুড় করে খাটিয়ার উপর রাখেন,
তারপর দুই হাত দিয়ে বরকতের পা দুখানি জড়িয়ে ধরেন।)
ওরা সবাই চইল্যা গেল, কেয়ামত আইছে। আল্লায় সবাইরে দোয়া করছেন, বরকতাইয়া শান্তি পাইছে, মকবুল শান্তি পাইছে, সালাম শান্তি পাইছে, সালমান শান্তি পাইছে সাদেক শান্তি পাইছে, হারুন শান্তি পাইছে। ওগো বাপে শান্তি পাইছে (তাঁর মাথা নিচু করে); ফেরেস্তায় আমার দিল পাথর কইরা দিছে রে নওরিন। আমাগো ছাইড়া সক্কলে চইল্যা গেল। এই দুনিয়ায় আমাগো আর কেউ রইল না।

(তিনি একটু থামলেন, সম্মিলিত মহিলাদের সবাই কান্নার স্বরটি একটু তুলেই আবার নিচুগ্রামে নামিয়ে ফেললেন)

মরিয়ম : (আবার বলা শুরু করলেন) মকবুল আল্লার রহমে পানির নীচে
দাফন পাইছে, বরকত সাদা কাডের কাফনে গোরে যাইব, অনেক গভীরে গোর দিমু। একটা মানুষ এর থিক্যা আর কিই বা পাইতে পারে? মানষে তো আর চিরকাল বাঁইচ্যা থাকবে না, এইডা আমাগো বুঝতে হইবে।

[তিনি আবার হাঁটুমুড়ে প্রার্থনায় বসলেন। ধীরে ধীরে মঞ্চের পর্দা পড়ে গেল।]

Facebook
Twitter
LinkedIn

Privious Cover Stories

মোসলেম মিঞার কড়চা

সঞ্জীব কুমার সাহা গল্পটা রাজবিহারের। রাজবিহার জেলায় এগারোটা ব্লকের অন্যতম হল চুয়াডাঙ্গা উন্নয়ন ব্লক। কাছেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত। তো এই চুয়াডাঙ্গা ব্লকের অফিসে মোসলেম মিয়া নামে

Read More »