ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ
সৌপর্ণ
আজ মাদারস্ ডে। মায়ের জন্য একটা দিন ডেডিকেটেড ভালোই তো। আমার তো স্কুলদশা ঘুচল না, এখনো বাড়ি ঢুকেই হাঁকডাক শুরু করে দিই…’মাআআআ খিদে পেয়েছে। খেতে দাও।’ মা ছাড়া একটা দিনও তো ভাবতে পারিনা। আমিও আজ মায়ের সাথে ফেবুতে ছবি আপলোডাবো, ‘দিওয়ার’ এর শশী কাপুরের মতো বলবো “মেরে পাস মা হ্যায়…” কিন্তু পরমুহুর্তেই একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল…
ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাচ্ছা ব্রেষ্ট ফিডিং বন্ধ করলেই আলাদা ঘরে শোয়ে। বাবা মায়ের প্রাইভেসিতে তার প্রবেশ ব্রাত্য। ন্যানির কাছেই মানুষ হয়। রবি ঠাকুরও ছোটবেলায় মাকে সেভাবে পাননি, চাকরের কাছেই মানুষ হতেন। সেই অভিমান শুধু জীবনস্মৃতি নয় , ডাকঘরের অমলের মধ্যেও ফুটে উঠেছে।
রবি ঠাকুরের কথা বরং থাক। পাশ্চাত্যের ওদেশগুলো তো আর আমাদের দেশের মতো নয়, মায়ের প্রগাঢ় সহচর্য ছাড়াই বাচ্চারা বড় হয়ে ওঠে। এমনকি বিয়ের পর শুধু মেয়েদের নয় ছেলেদেরও বাড়ি ছেড়ে নতুন জায়গায় নতুন করে সংসার শুরু করতে হয়। এটাই প্রথা। সমানুপাতিক সমানাধিকারের প্রসঙ্গ তুলছি না , কিন্তু জাস্ট ম্যারেড এর প্রাইভেসি অক্ষুন্ন থাকে। উইক এন্ডে দুজনেই ঘুরে যায় দুজনের বায়োলজিক্যাল প্যারেন্টদের ফ্ল্যাটে । তাই তাদের জীবনে আলাদা করে মাদারস্ ডে পালন করতে হয়। এবং ওদের লাইফ স্টাইলে সেটা খুব জরুরী।
কিন্তু আমাদের … একদিনও মা ছাড়া ভাবতে পারিনা। ছোটবেলায় থেকে মায়ের উপর নির্ভরশীল। যত আব্দার মায়ের কাছে। খুব বিরক্ত করলে সেই অমোঘ ডায়লগ ‘ খুব বাড় বেড়েছিস না, দাঁড়া বাবা আসুক সব বলব।’ জানতাম এ থ্রেট শুধুই শান্ত করার জন্য। কুপুএ যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়। মা আছে মানে ব্যাস সব মুস্কিল আসান। পরম নির্ভরতায় বলতাম ‘ওমা আমার বইটা দেখেছো, আমার টিফিন বক্সটা কোথায়?’ নিজে খুঁজে না পেলেই সেই পাড়া জাগানো চিৎকার ‘ওমা আমার সাদা শার্টটা দেখেছ? আমার ডেনিম জিন্সটা কোথায় গো মা?’ মাও হাসি মুখে এই নির্ভরশীলতাকে আপন করে নেন। বাচ্চাকে ‘মানুষের মতো মানুষ’ করার মহান ব্রতে ব্রতী হয়ে, প্রাইভেসি নামক শব্দটাই জীবন থেকে ডিলিট করে দেন। তাদের সবটুকুই যেন সন্তানের জন্য, সন্তানকে ঘিরে। ঠিক যেন মোমবাতির মতো, নিজে নিঃশেষ হয়ে আজীবন আমাদের আলো দিয়ে যান।
মেয়েরা অবশ্য বিয়ের পর মাকে ছেড়ে আসে। নতুন জীবনে শাশুড়ি কতটা মা হয়ে ওঠেন সে বিতর্কে আমি যাচ্ছি না। জীবনটা তো আর ‘পারমিতার একদিন’ নয়। সাস্ বহু সম্পর্কের রসায়ন যেমনই হোক না কেন, প্রেগনেন্সি পিরিয়ডে বাপের বাড়ি থাকতেই মেয়েরা বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করে। অনেক গুলো কারণের মধ্যে প্রধান কারণ কিন্তু মানসিক নির্ভরতা , একটা কম্ফোর্ট জোন । যদিও আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই স্বার্থপর। প্রথা মেনে বৌকে বাপের বাড়ি রেখে আসিনি , প্রতিদিন একটু একটু করে তার পরিপূর্ণ মা হয়ে ওঠার মূহুর্তগুলোর সাক্ষী হওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত হতে দিইনি।
আমার কথা থাক। কোভিড লকডাউনে অন্যতম প্রাপ্তি মাতৃসঙ্গসুধা। ওইসময়ে অনেক বেশি করে সময় দিতে পেরেছি মাকে। মাও তার নতুন করে টেলিকাস্ট না হওয়ায় সান্ধ্যকালীন সিরিয়ালের আসর থেকে বেরিয়ে আমাদের সাথে সময় কাটিয়েছে। করোনার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের কাজে আবার নিমগ্ন হয়ে গেলাম, মাও নতুন সিরিয়ালে নতুন কোনো নায়িকার জীবনে হেব্বি দুঃখের চিত্রনাট্যে নিমজ্জিত হয়ে গেল। শুধু এই সময়টুকু স্মৃতি হয়ে থেকে গেল মনের মণিকোঠায়।
এভাবেই মা আমাদের জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত , তাই আমার বা আমাদের কাছে কিন্তু ৩৬৫ দিনই মাদারস্ ডে । এমনকি ফ্রয়েডের অডিউইপাস থিয়োরি এর সপক্ষেই যুক্তি প্রদান করে। হ্যাঁ স্বীকার করছি মায়ের জন্য গ্রিটিংস কার্ড , ক্যাডবেরি বা ফুল দিয়ে বাহ্যিক আড়ম্বরপূর্ণ মাদারস্ ডে পালন করিনি। কিন্তু মাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড ও করে ফেলিনি। মা অভ্যাসে নয় , প্রতি দিনের মননে আছেন এবং থাকবেন।