( কন্নড় ত্রিপদী লোকগাথা )
তাঁর বিশ্বাস
১
তোমার নামের বীজ বুনব কোথায় বাপ্?
মনে হয় জিভের ডগায়, বুনব তোমার নাম,
আর ওখানেই তুলব তোমার নামের ফলন।
২
বাপ্, রোজ সাঁঝের বেলা, নয় নিশুত রাতে,
প্রতিদিনই আসব তোমার দেউল-ধামে।
দেখব, তোমার রতন দুয়ার, হাট করে খোলা।
৩
সাত সকালে শিকারে যায় বিলিগিরির রাজা,
সাদা ঘোড়ায় টগবগিয়ে খোলা তরবারি,
তরবারির ঝলকানিতে ঝলসে যায় মুখ।
৪
তিনি এলে মিষ্টি গন্ধে ভরে আমার উঠোন।
ঘাস ফুলেতে ভরে চরাচর,
পুবের দিকে বৃষ্টি ঝিরিঝির।
মা
৫
আত্মীয়-স্বজন অনেক, কিন্তু মায়ের মতো নেই।
রান্না ঘরে চুলার ভিতর জ্বলে গোছাগোছা কাঠি,
দীপের মতো আলো দেয় কি কেউ?
৬
বাছুরগুলো চরে ফেরে বাড়ি,
আনন্দেতে মায়ের কাছে ছুট্টে যায় ওরা।
আমিও ভাবি, মায়ের কাছে যাই।
৭
সঙ্গীসাথীর সাথে, ঝরনাতলায় যাই।
তাদের কাছে বলি আমার মায়ের কথা,
হঠাৎ করে ঝরনা ঝরঝর।
মায়ের দুঃখ
৮
গাছের ডালে সবুজ কুশি আম,
উড়ন্ত সব তোতাপাখি—আহা চমৎকার!
এই বাড়িতে অসীম খুশি যখন তুই আমার পাশে।
৯
ওরে তুই আমার ভালোবাসার ফল।
পুরো নয় মাস আমি এই গর্ভে ধরেছি তোকে।
ওরে আমার রঙিন পুতুল, কেমন করে বলব তোকে বিদায়?
১০
হায়, মেয়েদের জন্ম দিতে হবে, বিদায় দিতে হবে,
আর বিদায় বেলায়, কাঁদতে হবে অঝোর।
রাগের ঝোঁকে দেবতাদেরও অভিশাপ দিতে হবে!
১১
ও ফুলওয়ালী বোন, এই ফুলগুলোকে কেন এনেছ এখানে?
যে পরতো মালা, খোঁপা সাজাত ফুলে,
সে তো চলে গেছে, সে এখন তার স্বামীর ঘরে।
১২
তোমার মেয়েরা সব চলে গেছে, যে যার বরের ঘর,
এই বারো ঘরের বাড়িতে একলা তুমি, কেমনে থাকো মা?
দেয়ালে আমাদের ছবি আঁকো—শান্তি পাবে মনে।
তার ভাইয়েরা
১৩
আমার চার ভাই, আমায় পাহারা দেয় ওরা
গোখরোর মতো ফণা তুলে। তাহলে আমি গরিব কীসে?
যা, আমাকে একজোড়া চুড়ি এনে দে, ভাই!
১৪
তুমি হয়ত গরিব হয়ে জন্মেছ বোন। কিন্তু তোমার সরু কোমর
কলাবতী কিশোরীর মত কমনীয় কোমল,
রাজপুত্র দেখলে ছাড়বে না তোমায়।
১৫
যখন বোন স্বামীর ঘরে রওনা দেয়, তখন তার ভাই উঠে যায়
সবচেয়ে উঁচু ঢিবির ওপর, দূর থেকে দেখে,অশ্রু মুছে নেয়
আর বিড়বিড় করে বলে, “তুই হারিয়ে যাচ্ছিস, বোন।”
১৬
নাচুনে ঘোড়ায় চড়ে আসে সে
তোতাপাখিকে কথা বলতে শেখায়।
পথ ছাড়ো, খালি কলসি!
১৭
শিশির বালি নয়, আর বালিও নয় চিনি।
রক্ষিতা কোন উত্তর নয়
যা ভাই, নিজের বউ নিয়ে আয়।
তার কিশোর প্রেমিক
১৮
ও রাস্তার অন্য পাড়ে থাকে।
আমি তার সাথে কথা বলতে পারি না, আসলে আমাদের বাড়িগুলো আলাদা।
আজ রাতে আমার স্বপ্নে এসো, আমার প্রিয় মেয়ে।
১৯
আপনারা যারা হাইরোডে ফুল বিক্রি করেন,
দাম বলুন, আমি কিনব।
আর বলো কনেপণ, আমি তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাব।
২০
সন্ধ্যার সময় পুকুর থেকে জল আনতে গেলাম।
দেখা হল হীরার আংটি পরা রাজকুমারের সাথে
আর ধাক্কাধাক্কিতে ভেঙে গেল আমার চুড়ি।
২১
চুরি করে যখন এই কৃষাণ ছেলেটি রাতের বেলা আসে
তখন সাদা রঙা চখাচখি উড়ে পালায়,
তার রুপোর আংটির আভায় তারা ভয় পায়।
২২
চালু এই ছেলেটার সাথে থেকে ফুল তুলতে শিখেছি আমি,
আর লতাগুল্মে হারিয়েছি আমি আমার রঙিন প্রবাল
তার পাশে থাকতে থাকতে আমি হারিয়েছি কত সোনাদানা।
২৩
কী যায় আসে সে যদি হয় মুতে মজুর?
একটা মেয়ের কাছে, তার স্বামী কি কখনও গরীব হতে পারে?
সে সব সময় আস্ত এক সোনার খনি!
২৪
জুঁই এনেছে ও, ওঁর কাপড়ের ভেতর লুকিয়ে
তারপর ভালোবেসে ছিটিয়ে দিয়েছে আমার গায়ে।
ওকে একা রেখে, আমি কী করে আসব মা?
২৫
সে চলে যাওয়ার পর থেকে আমার জীবন
হয়ে গেছে ছাঁচে ঢালা ভুট্টার মতো, আগাছার বাগান,
কিংবা রশি ও ভাড়ঁ ছাড়া শুনশান কুঁয়োতলা।
ওর নান্নি মুন্নী
২৬
আমাকে সন্তান দাও, ঈশ্বর। চাইব না অন্য কোনো বর।
আমার এই আশীর্বাদ স্থায়ী হোক। আমি যেন গর্বের সাথে
অন্য সব বউদের সাথে নদী থেকে জল আনতে পারি।
২৭
ফাঁদে পরা এই তোতাটিকে আমি পেয়েছি,
এর ঠোঁট মুক্তো এবং রত্ন দিয়ে মোড়া।
ভগবানের দয়ায় পেলাম ওকে।
২৮
আমার সন্তান ভালো সোনা, খুব চটপটে তাই ও।
সে এক জাদু কারিগর যিনি ওকে যত্ন করে
বানিয়েছেন নরম রেশমের গোলা দিয়ে।
২৯
আরে ওই, আমি ডাকি। সে মুখ ফিরিয়ে হাসে।
কে ডেকেছে তোকে, আমার সোনা মনা?
আমি তো শুধু ইশারা করেছি তোতাপাখিটাকে।
৩০
বেঁকে ঝুঁকে, তার কানের দুল দুলছে, আহা,
বানর ছানার সাথে সে কীভাবে খেলে বল! তাকে দেখে,
কোন মেয়ে না চায়, অমন এক সন্তান!
৩১
যখন সে কাঁদে, তার ঠোঁট যেন প্রবাল-মঞ্জরী,
ভ্রু দুখানি ঝিরিবিরি নিম পাতা।
তার চেহারায় শিবের ত্রিশূল ঝলকায়।
শাশুড়িমায়ের কাছে
৩২
ভাল্লুকের দুধ দোয়া কিংবা বাঘিনীর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার সামিল!
তেল নুন মাখন তালা-চাবি দিয়ে রাখেন তিনি।
এত হাত টান, এ বাড়িতে আমি বাঁচব কী করে?
৩৩
তুমি চাইলে আমি একশো হাঁড়ি পাতিল মেজে দেব।
কিন্তু আমার বাপ্-মাকে শাপ-শাপান্ত কোর না।
ওরাই আমাকে দিয়েছে মণি, মুক্তা ও গয়না।
৩৪
আমার বর হাজার গাল দিলে আমিও কাঁদি না।
কিন্তু তার ভাই যখন একটা কথাও শোনায়,
মনে হয় ছাদহীন ঘরে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছি অঝোর।
বাড়ির চিন্তা
৩৫
বৃষ্টি হোক, কিন্তু দেখো যেন নদী না ভেসে যায়।
আমার মায়ের বাড়ি নদীর অন্য পাড়ে,
নদী পেরোতে দিতে হবে কানের সোনা।
৩৬
আমার মায়ের বাড়ির পথে কোন পাথর বা ঝাড়বাতি নেই।
এমনকি সরষে দানার মত বালিও নেই।
মাথার উপরে সূর্য জ্বলে না।
বিদায়, আমার গান গাওয়া পাথর
৩৭
আমাদের দানা পেষা শেষ, কিন্তু আমাদের গানের রেশ
রয়ে গেছে,খুলে পড়েছে আঙুলের আংটি।
বিদায় পাথর, আমার গাইয়ে জাতাকল।
৩৮
তুমি কি বিরক্ত হয়েছ যে আমি ছেড়েছি জাতাকল পাথর,
আমার পরীমণি? বেশ ঝুড়িতে ভুট্টা বাড়ুক কয়েকগুণ,
আমি আসব আবার আজ রাতে।
[সাহিত্য একাডেমির দ্বিমাসিক পত্রিকা ইন্ডিয়ান লিটেরেচার-এর ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় (নং-১২৩) প্রকাশিত The Singing Stone সূচক ইংরেজি অনুবাদ থেকে গৃহীত]