লক্ষ্মী এলেন

লক্ষ্মী এলেন

আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। শরতের আকাশে জ্বলজ্বল করবে পূর্ণচন্দ্র, বাংলার ঘরে ঘরে হবে আজ লক্ষ্মীপূজা। ধানের শীষ, প্রদীপের আলো, দুধ-চালের পায়েস, আর কাঁসার থালায় সাজানো ফলমূল—এইসবের মধ্যে দিয়ে বাঙালির গৃহজীবন আজ এক অপূর্ব মাধুর্যে ভরে উঠবে। তবে যে দেবী আজ পূজিতা হবেন, তিনি কে? কেবল ধন-সম্পদের প্রতীক, না কি নৈতিক স্থিতি, সৌন্দর্য ও সৃজনশক্তির দেবী? ভারতীয় পুরাণ, শাস্ত্র ও সাহিত্যের গভীর থেকে তাঁর উৎস ও বিস্তারের সন্ধানেই এই আলোচনা।

‘লক্ষ্মী’ শব্দটির মূল সংস্কৃত ধাতু “লক্ষ্”, অর্থাৎ দেখা, চিহ্নিত করা বা লক্ষ্য করা। তাই লক্ষ্মী মানে—যিনি লক্ষ্যনীয়, যাঁর উপস্থিতি শুভ ও চিহ্নময়।

ঋগ্বেদে তাঁর প্রাথমিক উল্লেখ পাওয়া যায়, “শ্রীং লক্ষ্মীং যঃ প্রপদ্যতে তন্মে মাভয়ং করোতু।” (ঋগ্বেদ, মণ্ডল ১০, সূক্ত ৮৫)

এখানে শ্রী ও লক্ষ্মীকে একাত্মা রূপে দেখা হয়েছে যেখানে শ্রী সৌন্দর্যের, লক্ষ্মী সমৃদ্ধির প্রতীক। শ্রীসুক্তে দেবীকে আহ্বান জানানো হয়েছে এই মন্ত্রে,“পদ্মপ্রিয়ে পদ্মিনী পদ্মহস্তে পদ্মালয়ে পদ্মদলায়তাক্ষি।” (শ্রীসুক্ত, ১)
অর্থাৎ, “হে পদ্মপ্রিয়া, পদ্মে আসীন, পদ্মহস্তা, পদ্মনয়না দেবী, তুমি এসো।”
এই পদ্মই তাঁর প্রধান প্রতীক—অলিপ্ত, নির্মল, জলে জন্মে অথচ জলমগ্ন নয়।

বিষ্ণুপুরাণ ও দেবীভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে—যখন দেবতা ও অসুরেরা ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করছিলেন, তখন চৌদ্দ রত্নের সঙ্গে উদ্ভূতা হন এক স্বর্ণাভ দেবী—লক্ষ্মী।
“সমুদ্রমান্থনমধ্যেতে শ্রীর্দেবী পরমা শুভা।”
(বিষ্ণুপুরাণ, পঞ্চমাংশ)

তিনি স্বয়ং বিষ্ণুকে স্বামীরূপে বরণ করেন, কারণ বিষ্ণু স্থিতির দেবতা, আর স্থিতিই সমৃদ্ধির ভিত্তি। তাঁর হাতে পদ্ম (পবিত্রতা), অলঙ্কারে স্বর্ণ (প্রাচুর্য), মুখে শ্রী (সৌন্দর্য)—এই তিনে গঠিত তাঁর দেবত্ব।
তবে লক্ষ্মী কেবল ধনের দেবী নন; তিনি ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চার পুরুষার্থের সমন্বয়।
শ্রীসুক্তে বর্ণিত হয়েছে, “অশ্বপুর্বা রথমধ্যা গবীর্হস্তোর্জম দধাতি।” (শ্রীসুক্ত, ৩) অর্থাৎ—‘তিনি অশ্বের মতো তেজস্বিনী, রথমধ্যস্থিত, গোরূপে উৎপাদনশক্তি ধারণ করেন; তিনি শক্তি ও প্রাচুর্যের প্রতীক।’

অতএব, দেবী লক্ষ্মী অর্থ দান করেন, কিন্তু সেই অর্থ নৈতিকতার ভিত্তিতে প্রাপ্ত হলে তবেই স্থায়ী হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থে লিখেছিলেন,“লক্ষ্মী ধন দিতে পারেন, কিন্তু চরিত্র দিতে পারেন না; চরিত্র থাকলে ধন আসে, চরিত্র হারালে লক্ষ্মীও ত্যাগ করেন।”

ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে নানান রূপ ও লোকবিশ্বাসে দেবী নানাভাবে পূজিতা হন। যেমন , বাংলা ও পূর্বভারতে দেবী লক্ষ্মী পূজিত হন গৃহলক্ষ্মী রূপে—ধান, আলো ও শান্তির দেবী। লোকগানে বলা হয়,“যার ঘরে ধান, তার ঘরে মা লক্ষ্মী,/যার ঘরে স্নান, তার ঘরে প্রাণ।”

কোজাগরীর রাতে নারীরা দুধ-চালের পায়েস রান্না করেন, প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন—
“এসো মা লক্ষ্মী , বসো ঘরে… “

দেবীর বাহন পেঁচা যা কিনা নির্জনতার মাঝে সতর্ক দৃষ্টি ও প্রজ্ঞার প্রতীক। ওড়িশা ও অসমে
লক্ষ্মী পূজা কৃষিজীবনের সঙ্গে যুক্ত। অসমে গাওয়া হয়, “লক্ষ্মী মা, আহি ধন আনিবি ঘৰে,
সুখে রাখিবি সবাইকৰে।”

দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র ও কর্ণাটকে পালিত হয় ভারলক্ষ্মী ভ্রত। নারীরা সংসারের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য উপবাস রাখেন। গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে দীপাবলির তৃতীয় দিনে পালিত হয় লক্ষ্মী পূজন, যেখানে নতুন হিসাবখাতা খোলা হয়। ভক্তরা প্রার্থনা করেন, “শুভলাভ করো মাতা, সুখসমৃদ্ধি দাতা।”

মহাভারতে শ্রীকে চিরন্তন বিজয়ের সঙ্গে যুক্ত করে বলা হয়েছে, “যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ। তত্র শ্রীর্ভূতিধ্রুবা নীতির্মতীর্মম।”
(ভগবদ্‌গীতা ১৮.৭৮) অর্থাৎ, যেখানে জ্ঞান (কৃষ্ণ) ও কর্ম (অর্জুন) মিলিত, সেখানেই শ্রী (লক্ষ্মী) বিরাজমান।

মহাকবি কালিদাস রঘুবংশে লক্ষ্মীর শোভা বর্ণনা করতে লিখেছিলেন,“শ্রীর্ভূতাভূতি ফলিনী হি গুণনৈপুণ্যেন ধনঞ্জয়ঃ।” অর্থাৎ, গুণ ও নৈতিকতার দ্বারা অর্জিত সমৃদ্ধিই প্রকৃত শ্রী।

তবে বিশ্বসংস্কৃতিতে নিম্নোক্ত লক্ষ্মী সমতুল্য দেবীদের দেখতে পাই, যেমন গ্রিক সংস্কৃতিতে Tyche দেবী সৌভাগ্য ও ভাগ্যের দেবী। আবার রোমান Fortuna হলেন ধন ও ভাগ্যের প্রতীক,
চীনে Caishen ও Guanyin হলুন যথাক্রমে সম্পদ ও দয়ার দেবতা। জাপানি দেবী Benzaiten হলেন শিল্প, সম্পদ ও সৌন্দর্যের দেবী। সুতরাং বলাযায় যে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসে এই সকল দেবীগণ মানবসমাজে “সমৃদ্ধির নৈতিক শক্তি”-র প্রতীক, যা ভারতীয় লক্ষ্মীচেতনার এক বৈশ্বিক প্রতিফলন।

।। কোজাগরী পূর্ণিমা : জাগরণের আহ্বান ।।

‘কো জাগরতি?’—অর্থাৎ “কে জেগে আছে?” এই প্রশ্ন থেকেই এসেছে কোজাগরী শব্দটি।
বৃহন্নারদ পুরাণে বলা হয়েছে,
“যে গৃহে এই রাতে জাগে, লক্ষ্মীস্তোত্র পাঠ করে,
দেবী সেখানে প্রবেশ করেন, দারিদ্র্য ত্যাগ করে।”
তাই আজ রাত জেগে থাকা মানেই আত্মশুদ্ধির সাধনা,আলোর মাধ্যমে অন্ধকারের পরাভব,
সত্য ও ন্যায়ের প্রতি জাগরণ।

লক্ষ্মী এলেন—এই বাক্য শুধু ধনলাভের প্রতীক নয়; এটি এক জীবনদর্শন।
তিনি আসেন কেবল সম্পদের নয়, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য, কর্মনিষ্ঠা ও নৈতিকতার দেবী রূপে।

“লক্ষ্মীং চ তদ্বিদুর্দেবাং স্থিতিরূপাং হরিপ্রিয়াম।”
(বিষ্ণুপুরাণ) অর্থাৎ—“যিনি স্থিতির প্রতিমূর্তি ও বিষ্ণুপ্রিয়া, তিনিই লক্ষ্মী।”

আজ কোজাগরীর আলোয় তাই বিশ্বাসীদের প্রার্থনা থাকুক , “এসো মা লক্ষ্মী, বসো ঘরে । আমার এই ঘরে থাকো আলো করে ।”

সূত্র ও গ্রন্থতালিকা :
(১) ঋগ্বেদ, মণ্ডল ১০, সূক্ত ৮৫ (২) শ্রীসুক্ত, ঋগ্বেদ-সংহিতা (খিলা অংশ) (৩) বিষ্ণুপুরাণ, পঞ্চমাংশ, অধ্যায় ৮ (৪) দেবীভাগবত পুরাণ, নবম স্কন্ধ (৫) মহাভারত, ভগবদ্‌গীতা ১৮.৭৮
(৬) কালিদাস, রঘুবংশম (৭) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণচরিত্র। (৮) রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (সম্পা.), বাংলা ও আসামের লোকসংগৃহীত পদাবলী, ভারতভারতী, ১৯১৫

Facebook
Twitter
LinkedIn

Letest Cover Stories

লক্ষ্মী এলেন

আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। শরতের আকাশে জ্বলজ্বল করবে পূর্ণচন্দ্র, বাংলার ঘরে ঘরে হবে আজ লক্ষ্মীপূজা। ধানের শীষ, প্রদীপের আলো, দুধ-চালের পায়েস, আর কাঁসার থালায় সাজানো ফলমূল—এইসবের

Read More »

তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে দেবী দুর্গা  

ড.পি.অনুরাধা  ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে দেবী দুর্গা এক বহুমাত্রিক প্রতীক। তিনি যেমন পুরাণে মহিষাসুরমর্দিনী, তেমনি গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিতে অন্নদাত্রী মাতৃরূপে বিরাজমান। সংস্কৃত সাহিত্যে দুর্গাসপ্তশতী (মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ) তাঁর পূজার

Read More »

Privious Cover Stories

লক্ষ্মী এলেন

আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। শরতের আকাশে জ্বলজ্বল করবে পূর্ণচন্দ্র, বাংলার ঘরে ঘরে হবে আজ লক্ষ্মীপূজা। ধানের শীষ, প্রদীপের আলো, দুধ-চালের পায়েস, আর কাঁসার থালায় সাজানো ফলমূল—এইসবের

Read More »

তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে দেবী দুর্গা  

ড.পি.অনুরাধা  ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে দেবী দুর্গা এক বহুমাত্রিক প্রতীক। তিনি যেমন পুরাণে মহিষাসুরমর্দিনী, তেমনি গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিতে অন্নদাত্রী মাতৃরূপে বিরাজমান। সংস্কৃত সাহিত্যে দুর্গাসপ্তশতী (মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ) তাঁর পূজার

Read More »

বৃত্ত পথের পরিক্রমায়

নিউজিল্যান্ডের মাওরি সাহিত্যিক উইতি ইহিমায়েরার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত কিউই লেখক ও আইনজ্ঞ ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গমের আলাপচারিতা । অনুবাদ করেছেন নবকুমার দাস।  উৎস : সিডনি বুক রিভিউ

Read More »