ড.পি.অনুরাধা

ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে দেবী দুর্গা এক বহুমাত্রিক প্রতীক। তিনি যেমন পুরাণে মহিষাসুরমর্দিনী, তেমনি গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিতে অন্নদাত্রী মাতৃরূপে বিরাজমান। সংস্কৃত সাহিত্যে দুর্গাসপ্তশতী (মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ) তাঁর পূজার মূলপাঠ হলেও আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে দুর্গার গ্রহণযোগ্যতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। দক্ষিণ ভারতের তামিল ও তেলেগু সাহিত্য এই ধারার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে দুর্গা কখনও যুদ্ধদেবী, কখনও স্নেহময়ী জননী, আবার কখনও গ্রামীণ আম্মান বা আঞ্চলিক মাতৃদেবীরূপে উদ্ভাসিত।
এই নিবন্ধে আমরা তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে দুর্গার উপস্থাপনাকে বিশদভাবে আলোচনা করব—প্রাচীন পাঠ ও লোককাব্য থেকে শুরু করে ভক্তি সাহিত্য, মধ্যযুগীয় কাব্য–নাটক এবং আধুনিক সাহিত্যে তাঁর প্রতীকী রূপ পর্যন্ত। পাশাপাশি দেবীসংস্কৃতির আঞ্চলিক রূপান্তর এবং দুই সাহিত্যভাষার মধ্যে তুলনাও টানা হবে।
সঙ্গম যুগের (খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০–খ্রিষ্টীয় ৩০০ অব্দ) কাব্যসাহিত্যে দুর্গার সরাসরি উল্লেখ বিরল। তবে যুদ্ধদেবী, শিকারিনী, বা মাতৃশক্তির প্রতীকমূর্তি সেখানে উপস্থিত। পট্টিনপাল্লৈ এবং পরিপাডাল প্রভৃতি গ্রন্থে দেবীকে কখনও পাহাড়–অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী, কখনও যুদ্ধক্ষেত্রের রক্ষক দেবী হিসেবে দেখা যায়। যদিও তাঁকে ‘দুর্গা’ নামে অভিহিত করা হয়নি, শক্তিদেবীর ধারণাটি সেখানে স্পষ্ট।
সপ্তম থেকে নবম শতকের ভক্তি আন্দোলনের সময়কার নায়নার ও আল্পারদের কাব্যে শক্তি রূপে দুর্গার উপস্থিতি পাওয়া যায় । তেভারম–এর কিছু স্তোত্রে দেবীকে শৈব শক্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে আল্পারদের বৈষ্ণব পদাবলিতে দুর্গাকে কখনও বিষ্ণুর সহচরী শক্তি হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে।
তামিল লোককবিতায় ‘আম্মান’ বা মাতৃদেবী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গা এখানে ‘কালী–আম্মান’, ‘মারিয়াম্মান’, ‘কাত্তাম্মান’ প্রভৃতি নামে পরিচিত হয়ে গ্রামীণ সমাজে পীড়ামুক্তি ও অন্নপ্রদাত্রী হিসেবে পূজিতা। এসব গান ও স্তোত্র তামিল কাব্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
মধ্যযুগীয় তামিল কাব্য–কথাসাহিত্যে দুর্গার চিত্রণ স্পষ্টতর হয়। দ্বাদশ শতকে রচিত কাম্বনের রামায়ণম –এ রাবণবধের পূর্বে রাম দুর্গার পূজা করেন। এই পর্বে দুর্গাকে জয়দেবী, বিজয়ের দেবী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
পরে তামিল লোকনাট্য তেরুক্কূথুতে মহিষাসুরমর্দিনীর কাহিনি বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষত দুর্গাপূজার সময়ে এসব নাটক মন্দির প্রাঙ্গণে অভিনীত হয়।
আধুনিক কালে দুর্গা নারীসমাজের সংগ্রাম ও আত্মমুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠেন। সুব্রামণিয় ভারতীর কবিতায় নারীর শক্তিকে দুর্গারূপে কল্পনা করা হয়েছে। ভারতী লেখেন—নারীকে অবদমিত নয়, শক্তিস্বরূপে পূজা করা উচিত। এভাবে দুর্গা তামিল জাতীয়তাবাদ ও নারীজাগরণের সাহিত্যেও প্রতীকী মর্যাদা লাভ করেন।

অন্যদিকে তেলেগু সাহিত্যের প্রারম্ভ থেকেই দুর্গা বিশেষভাবে পূজিতা। ১১শ শতকের নন্নায় ভট্ট, দ্বাদশ শতকের তিক্কনা, চতুর্দশ শতকের এর্রাপ্রগাদা—এই ত্রয়ীর মহাভারত অনুবাদ–এ দুর্গার শক্তিমূর্তি স্থান পেয়েছে।
তেলেগু কবিদের স্তোত্রসাহিত্যে মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্র–এর প্রভাব স্পষ্ট। দুর্গা এখানে শত্রুনাশিনী ও রাজ্যরক্ষক দেবী।
পঞ্চদশ শতকের ভক্ত কবি তাল্লাপাক আন্নমাচার্য তাঁর অসংখ্য কীর্তনায় দুর্গাকে মাতৃশক্তি ও ভক্তরক্ষক হিসেবে গেয়েছেন। যদিও তাঁর মূল ভজন ভেঙ্কটেশ্বরকে নিবেদিত, তবুও সেখানে দুর্গা ভক্তের দুঃখমোচনকারিণী। পরবর্তী কীর্তনকার ও ভক্তকবিরাও দুর্গাকে দারিদ্র্য–অশুভ–দৈন্যবিনাশিনী দেবী হিসেবে স্তব করেছেন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের দুর্গাসপ্তশতী তেলেগু ভাষায় একাধিকবার অনুবাদ হয়েছে। বিশেষ করে বিজয়ওয়াড়ার কনকদুর্গা মন্দিরকে কেন্দ্র করে তেলেগু কবিরা অসংখ্য স্তোত্র রচনা করেন। কনকদুর্গা দেবী এখানে আঞ্চলিক পরিচয়ে জাতীয় দেবীর রূপ ধারণ করেছেন।
লোকনাট্য যক্ষগানম্ ও ভুর্রকথায় মহিষাসুরমর্দিনী কাহিনি নিয়মিতভাবে অভিনীত হয়। এতে দেবীর বীরত্বের সঙ্গে ভক্তিরসও যুক্ত থাকে।
আধুনিক যুগে দুর্গা সামাজিক প্রতীক হয়ে ওঠেন। কবি শ্রীশ্রী তাঁর প্রগতিশীল কবিতায় নারীশক্তিকে দুর্গারূপে উদযাপন করেছেন। সমসাময়িক নাটক ও উপন্যাসে দুর্গা প্রায়শই সামাজিক ন্যায় ও শোষণবিরোধী সংগ্রামের প্রতীক।
তবে তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে দুর্গার উপস্থাপনায় কিছু মিল ও অমিল দেখা যায় যেমন, উভয় সাহিত্যেই দুর্গা গ্রামীণ মাতৃদেবীর সঙ্গে একাত্ম। মহিষাসুরবধ কাহিনি ও দুর্গাসপ্তশতীর প্রভাব উভয় ভাষায় প্রবল। আধুনিক যুগে দুর্গা নারীশক্তি ও সমাজসংগ্রামের প্রতীক। যদিও তামিল সাহিত্যে দুর্গা অধিকাংশ সময় আম্মান বা কালী–মারিয়াম্মান রূপে গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান; শৈব ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর যোগ ঘনিষ্ঠ। তেলেগু সাহিত্যে দুর্গা মূলত রাজ্যরক্ষক ও আঞ্চলিক মন্দির–কেন্দ্রিক দেবী; ভক্তি কীর্তন ও দুর্গা মাহাত্ম্যের অনুবাদ এখানে বেশি প্রভাবশালী।
সুতরাং দুর্গা তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে কেবল দেবী নন, বরং বহুমাত্রিক প্রতীকঃ যেমন।মহিষাসুরবধ কাহিনির মাধ্যমে তিনি শত্রুনাশিনী। আম্মান ও কনকদুর্গা রূপে তিনি গ্রামীণ সমাজের আরোগ্যদাত্রী ও অভিভাবক তথা রক্ষাকর্ত্রী । ভারতী বা শ্রীশ্রীর কাব্যে দুর্গা নারীসমাজের মুক্তির প্রতীক। আধুনিক নাটক–কবিতায় দুর্গা শোষণবিরোধী সংগ্রামের মুখ।
এক কথায় বলা যায় যে তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে দেবী দুর্গার উপস্থিতি আঞ্চলিক দেবীসংস্কৃতি ও সর্বভারতীয় পুরাণ–ভক্তির সমন্বয় ঘটিয়েছে। তাঁর রূপান্তর ঘটেছে পুরাণের যুদ্ধদেবী থেকে গ্রামীণ মাতৃদেবী, ভক্তের রক্ষক থেকে আধুনিক সামাজিক প্রতীকে। এই বহুমাত্রিকতা দুর্গাকে কেবল ধর্মীয় দেবী হিসেবে নয়, বরং সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে দুর্গা আজও জীবন্ত—লোককাব্য, নাটক, ভক্তি পদাবলি, আধুনিক কবিতা ও উপন্যাসে তিনি মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছেন।



