বৃত্ত পথের পরিক্রমায়

বৃত্ত পথের পরিক্রমায়

নিউজিল্যান্ডের মাওরি সাহিত্যিক উইতি ইহিমায়েরার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত কিউই লেখক ও আইনজ্ঞ ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গমের আলাপচারিতা । অনুবাদ করেছেন নবকুমার দাস। 

উৎস : সিডনি বুক রিভিউ ৪ঠা নভেম্বর ,২০১৯  

“মাওরি সংস্কৃতি আমার তাঙ্গা বা রত্নভাণ্ডার যেখান থেকে আমি লেখালিখির উপাদান ও অনুপ্রেরণা আহরণ করি। আমি কীভাবে ইউই গোষ্ঠীর মানুষদের ও তাদের কাহিনিগুলোকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে থাকতে পারি ? তাদের ছাড়া তো আমার অস্তিত্বই  সম্ভব নয় । আমার সাহিত্যকর্মের উৎসমুখ তো আমার বাপ-দাদার পৈতৃক নিবাস  ওয়াইতুহি গ্রামে। সেখানেই আছে আমার শিকড়ের সন্ধান, যেখানে সারাবছরই চারপাশে গল্প বলা হতো, গান গাওয়া হতো, অভিনয় মঞ্চস্থ হতো। সেটিই আমার ঠাইঁ নাড়া বা  নিজস্ব দাঁড়ানোর স্থান বা ভিত্তিমূল, যেখানে দাঁড়িয়ে আমার সাহিত্যিক জীবনযাত্রার সূচনা। আমার মাওরি সত্তার ইতিহাস সেখানে নিহিত, আর সেখান থেকেই এই রেও বা ভাষা, ইহি বা প্রাণশক্তি,মানা বা মর্যাদা এবং ওয়েহি বা সম্ভ্ৰম এসেছে। সেখানে আমি নিজেই আমার রাজা। আমি যা করেছি, তা হলো এই সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ধারাকে ওহাকাপাপা  বা পরম্পরায় অনুবাদ করে চলেছি , অর্থাৎ আমার চারপাশের এই জীবন্ত জগৎ, তার মৌখিক ঐতিহ্য ও শ্রুতিনন্দন শক্তিকে অন্য এক ভাষায় অর্থাৎ ইংরেজিতে, লিখিত রূপে রূপান্তরিত করেছিমাত্র।”উইতি ইহিমায়েরা 

উইতি ইহিমায়েরা। ছবি: অ্যান্ডি ক্রাউন

উইতি ইহিমায়েরা নিউজিল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্র লেখক। তাঁর দীর্ঘ  সাহিত্যজীবনে লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প, উপন্যাস, অমনিবাস, অপেরা-লিব্রেত্তো ও প্রবন্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দশকে সংঘটিত মাওরি পুনর্জাগরণ (Māori Renaissance)-এ তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি তরুণ লেখকদের কাছে একজন আদর্শস্থানীয় ব্যক্তি এবং তাঁর সাহিত্যকর্ম বিশ্বজুড়ে প্রভাব ফেলেছে- যেমন অস্কার মনোনীত চলচ্চিত্র Whale Rider-এর কাহিনি তাঁর লেখার দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাছাড়া তিনি ইতিমধ্যেই ফরাসি সরকারের Chevalier de l’ordre des Arts et des Lettres ,( শিল্প ও সাহিত্য কর্মের জন্য প্রদত্ত নাইট,২০১৭) উপাধি লাভ করেছেন।

২০১৪ সালে তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন, Māori Boy: A Memoir of Childhood, যা নিউজিল্যান্ডের শীর্ষ সাহিত্যসম্মান Ockham New Zealand Book Awards-এ নন–ফিকশন বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছে । প্রথম খণ্ডে ইহিমায়েরা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর শৈশব, ওহাকাপাপা বা বংশপরম্পরা এবং তাঁকে ঘিরে থাকা পাকেহা বা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক জগত।

এই স্মৃতিকথার দ্বিতীয় খণ্ড Native Son: The Writer’s Memoir  প্রকাশিত হয়েছে  ২০১৪ এর সেপ্টেম্বর মাসে । এতে ইহিমায়েরা তাঁর প্রারম্ভিক যৌবনের বছরগুলিকে উজ্জ্বলভাবে বর্ণনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন কীভাবে তিনি বহু অন্তর্দৈত্য ও বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করে একজন প্রকাশিত লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। বইটি একদিকে মর্মস্পর্শী, অন্যদিকে উদার; ষাট ও সত্তরের দশকের জীবনচিত্রের জীবন্ত চিত্রায়ন, পাশাপাশি গভীর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে যা তাঁর বিশ্বদর্শনকে প্রভাবিত করেছে। 

অন্যদিকে ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম (জন্ম ২০ অক্টোবর ১৯৮৩, শ্রীলঙ্কা) একজন নিউজিল্যান্ডের লেখক এবং পেশাদার আইনজীবী। তিনি বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরের একটি আইন সংস্থায় কর্মরত আছেন ।

—————————————————————————————————–

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম : “আপনার মাওরি বয় লেখায় আমি সেই বাক্যটি খুব পছন্দ করেছি, যেখানে আপনি লিখেছেন, ‘লোকজন আমাকে সৃজনশীল জানে , কিন্তু আসলে আমি শুধুমাত্র একজন কঠোর পরিশ্রমী এবং নিয়মানুবর্তী মানুষ।’ আপনার জীবনে আপনি তো অনেক কিছু করেছেন—তবুও কেন লেখালেখিকে জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে রেখেছেন ?”

উইতি ইহিমায়েরা: আপনি চাইলে এরজন্যে আমার ব্যক্তিগত ইতিহাসকেও দায়ী করতে পারেন, আবার রাজনৈতিক ইতিহাসকেও। তবে আমি সাধারণত প্রশংসা থেকে একটু দূরে থাকি, অথবা প্রকৃত অর্থে প্রশংসায় অবিশ্বাসী। আমি ধরে নিচ্ছি, সৃজনশীল বলতে প্রশংসা বোঝানো হয়েছে, তাই তো? আমি বরং মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে চাই আমার কঠোর পরিশ্রমের দিকে—যা আমাকে একজন মাওরি লেখক হিসেবে এখানে নিয়ে এসেছে, লেখক হিসেবে তো নয়ই, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো আমি এটিই ধরে রাখার প্রচেষ্টা করে যাই । মাওরিরা এটিকে বলে মাহি ই  তে মাহি অর্থাৎ ‘কাজের মধ্যেই কাজ করা’।

আমি ১৯৫৯ সালে, যখন আমার বয়স মাত্র ১৫, Te Karaka District High School–এ পড়তাম, তখনই এই mahi শুরু করি এবং বুঝতে পারি যে আমি যে বইগুলো পড়ছি তাতে মাওরিরা অনুপস্থিত। তারপর আমি নিউজিল্যান্ডের সাহিত্য সংকলন (anthology) পড়ি, সেখানে একটি ছোটগল্প ছিল মাওরির ওপর, লেখা এক Pākehā (ইউরোপীয়/শ্বেতাঙ্গ) লেখকের দ্বারা। গল্পটি এতটা বিষাক্ত ছিল যে আমি সেই বইটি জানালা দিয়ে বের করে দিই। এ জন্য আমাকে বাঁশের লাঠি মারা হয়েছিল। আমার মনে হয় এই দুইটি জিনিস—আমাদের সংস্কৃতিকে অদৃশ্য বা পাশ কাটিয়ে দেওয়া এবং সেই স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য শাস্তি—আমাকে দৃঢ় সংকল্প করতে বাধ্য করেছিল যে, ‘যাচ্ছেই, আমি একজন মাওরি লেখক হবো, মানুষ যেমন ভাবুক না কেন।’

আমার সাহিত্যজীবন এমন একটি পথ যা, হ্যাঁ, আমি কঠোর পরিশ্রমী এবং কঠোরভাবে জীবনযাপনকারী। কঠোর জীবনযাপনের অনেক কারণ আছে; যেমন, লেখক হওয়া কখনো আমার স্থায়ী আয়ের মাধ্যম হয়নি, তাই আমাকে কাজ করতে হয়েছে এবং লেখালিখি তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। তবে , আমি কোনো অভিযোগ করছি না। যেমন আমার কৃষক পিতা বলতেন, ‘মাটি খুঁড়ে বেড়া দেওয়ার থেকে এটা তো অনেক ভালো কাজ।’

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: আপনার বইগুলোতে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে—আপনার সাহিত্যিক ওহাকাপাপা বা বংশপরম্পরা স্বীকার করার মনোভাব। আপনাকে প্রায়শই নিউজিল্যান্ডের প্রথম মাওরি (Māori) ঔপন্যাসিক হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে, বিশেষত পাকেহা বা ইউরোপীয় সাহিত্যবর্ণনায়। অথচ এই ধরণটি আসলে পাশ্চাত্য সাহিত্য–ধারণাকেই বিশেষ সুবিধা দেয়। এই ভুল ধারণা সংশোধন করা এবং সেই সঙ্গে মাওরি সাহিত্যিক ঐতিহ্য, যেগুলো তাদের প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা আপনার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

উইতি ইহিমায়েরা: “মাওরি সংস্কৃতি আমার তাঙ্গা বা রত্নভাণ্ডার যেখান থেকে আমি লেখালিখির উপাদান ও অনুপ্রেরণা আহরণ করি। আমি কীভাবে ইউই গোষ্ঠীর মানুষদের ও তাদের কাহিনিগুলোকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে থাকতে পারি ? তাদের ছাড়া তো আমার অস্তিত্বই  সম্ভব নয় । আমার সাহিত্যকর্মের উৎসমুখ তো আমার বাপ-দাদার পৈতৃক নিবাস  ওয়াইতুহি গ্রামে। সেখানেই আছে আমার শিকড়ের সন্ধান, যেখানে সারাবছরই চারপাশে গল্প বলা হতো, গান গাওয়া হতো, অভিনয় মঞ্চস্থ হতো। সেটিই আমার ঠাইঁ নাড়া বা  নিজস্ব দাঁড়ানোর স্থান বা ভিত্তিমূল, যেখানে দাঁড়িয়ে আমার সাহিত্যিক জীবনযাত্রার সূচনা। আমার মাওরি সত্তার ইতিহাস সেখানে নিহিত, আর সেখান থেকেই এই রেও বা ভাষা, ইহি বা প্রাণশক্তি,মানা বা মর্যাদা এবং ওয়েহি বা সম্ভ্ৰম এসেছে। সেখানে আমি নিজেই আমার রাজা। আমি যা করেছি, তা হলো এই সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ধারাকে ওহাকাপাপা  বা পরম্পরায় অনুবাদ করে চলেছি , অর্থাৎ আমার চারপাশের এই জীবন্ত জগৎ, তার মৌখিক ঐতিহ্য ও শ্রুতিনন্দন শক্তিকে অন্য এক ভাষায় অর্থাৎ ইংরেজিতে, লিখিত রূপে রূপান্তরিত করেছিমাত্র।

আমি যা করেছি, তা হল সেই সাহিত্যিক ওহাকাপাপা —সেই জীবন্ত জগৎ ও তার মৌখিক ঐতিহ্যকে লিখিত জগতে নিয়ে আসা, একটি ভিন্ন ভাষায়—ইংরেজিতে। পৌনামু ,পৌনামু [Pounamu, Pounamu] (১৯৭২) থেকে শুরু করে আমার প্রতিটি বইয়ের কাজ ছিল এটিই: পাশ্চাত্য (Pākehā) জগতে আমার উপজাতীয় বংশগাথাকে কল্পনার মাধ্যমে পুনর্নির্মাণ করা। প্রাচীন বাস্তবতাকে নতুন সৃজনশীল উপায়ে দেখানো, বইগুলোকে তাদের মূল উৎস—যা আমরা বলি পুরাকাও (pūrākau) বা  মিথ-এর সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া । নিজেকে আমি ভাবি এক খোদাইশিল্পী হিসেবে, কারণ মাওরিদের কাছে খোদাই–কলা–ও সাহিত্য। কিংবা একজন উল্কিশিল্পী, কারণ তা মোকো (tā moko) বা  উল্কি ও সাহিত্য; যেন সাদা পাতার ওপর কালো অক্ষরের উল্কি আঁকা।

তবে শুধু মাওরি সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং মাওরি ইতিহাস পুনরুদ্ধার করাও আমার উদ্দেশ্য ছিল অন্তত সেটিকে ক্ষমতাসীন পাকেহা (Pākehā)দের চোখে চোখ রেখে। শেষ পর্যন্ত এটাই তো আমার শৈশবের অঙ্গীকারকে তাড়িত করেছিল।

আর মাওরি জনগণের পক্ষে বলতে গেলে, আমি লিখছিলাম ষাট–সত্তরের দশকের সেই সময়ে, যখন গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের ঢল নামছিল। তাই আমি সাহিত্যকেও ভৌগোলিক অর্থে তাদের গন্তব্যের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আর সেই ‘তারা’ ছিল এক নতুন প্রজন্ম, যারা ইংরেজি ভাষায় কথা বলত ।

যতদূর মনেপড়ে ‘প্রথম মাওরি ঔপন্যাসিক’ ট্যাগের ব্যাপার, সেই সময়ে অনেক রকম ‘প্রথম’ ছিল! হোনে তুফারে (Hone Tuwhare)—প্রথম প্রকাশিত মাওরি কবি। আলবার্ট ভেন্ড্ট (Albert Wendt)—প্রথম প্রকাশিত সামোয়ান লেখক। প্যাট্রিসিয়া গ্রেস (Patricia Grace)—প্রথম প্রকাশিত মাওরি নারী লেখক। প্যাট হেরেতাউঙ্গা বেকার (Pat Heretaunga Baker)—প্রথম মাওরি ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যকার। আমার মনে হয়, এগুলো ছিল প্রভাবশালী সংস্কৃতির নিজেকে বাহবা দেওয়ার এক রকম কৌশল।

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: আপনি যখন প্রথম লেখালেখি শুরু করলেন, তখন পাকেহা (Pākehā) বা পাশ্চাত্যের  মুখোমুখি হওয়া কেমন ছিল ? আমরা যদিও মাওরি সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে স্বীকার করতে পারি, তবুও সেই সময়ে পশ্চিমাদের সামনে এগুলো কার্যত খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আপনি যখন লিখতে শুরু করলেন, তখন কতখানি আপনি ভেতরে ভেতরে সেই আচেবে–র উক্তিটিকে গ্রহণ করেছিলেন, যেটির উল্লেখ আপনি Native Son–এ করেছিলেন—‘আমার ধীরে ধীরে বোধ হতে লাগল যে, যদিও কথাসাহিত্য নিঃসন্দেহে কল্পিত, তা তবু সত্য বা মিথ্যা দুটোই হতে পারে।’

উইতি ইহিমায়েরা: আসলে ব্যাপারটা হলো, আমাকে মাওরিদেরও মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমি যে ওয়াইতুহি উপত্যকার মানুষ, তারা নিউজিল্যান্ড যুদ্ধের সময় Pākehā–দের বিরুদ্ধে লড়েছিল (আমরা বিদ্রোহী নেতা তে কুটি আরিকিরাঙ্গিকে অনুসরণ করতাম), কিন্তু পরবর্তীকালে অনেক মাওরি ‘আমরা এক জাতি’—এই মতবাদকে গ্রহণ করেছিল। তবে আমার বিদ্রোহী উত্তরাধিকার আমাকে অন্য কোনো পথ দেয়নি, আমি লিখবই, এবং এক ইঞ্চিও পিছু হটার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের গোষ্ঠীর প্রবাদ হলো—“Te Whānau a Kai hei panapana maro বা  তে উহানাও আ কাই কখনো পিছু হটে না”—আর আমিও পিছপা হইনা। তবে যখন বলেছিলাম যে আমি মাওরিদের নিয়ে লিখব, তখনও ভাবিনি যে একজন লেখক হিসেবে সেই যাত্রায় আমাকে আমার নিজের জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও বাদানুবাদে জড়াতে হবে।

পাশ্চাত্যের বা Pākehā সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়ানোটা বরং সহজ ছিল, কারণ ১৯৭০–এর দশকে সরকার দ্বি-সাংস্কৃতিকতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল—যেহেতু চুক্তির অংশীদার হিসেবে মাওরিদের সমান অধিকার, সুরক্ষা এবং মর্যাদা পাওয়ার কথা ছিল; ফলে সমালোচনাও অনুমোদিত ছিল। তবে আমার ক্ষেত্রে কিছু Pākehā মনে করত যে আমার কাজ মাঝে মাঝে পুনর্মিলনের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। সব সময় নয়, কারণ মাঝে মাঝে আমি অন্তর্ভুক্তিমূলক বইও লিখেছি, যেমন The Whale Rider (১৯৮৭) এবং Bulibasha (১৯৯৪)। তবে সত্যি বলতে, মাওরিদের মধ্যেও এক ধরনের ধারা ছিল, যারা দ্বি-সাংস্কৃতিকতার বদলে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব (tino rangatira) চাইত।

আপনি বুঝতেই পারছেন আমি কোন দিকে ছিলাম। মুখে আমি দ্বি-সাংস্কৃতিকতার পক্ষপাতী বলতাম, কিন্তু আমার কাজ আসলে উল্টোটাই দেখাত। আমি সাহিত্যিক অস্ত্র হিসেবে বেরো (wero বা ঐতিহ্যবাহী দ্বন্দ্ব ) ব্যবহার করতে শুরু করলাম। যেমন, আমার নাটক Woman Far Walking (২০০০)–এ মূল চরিত্র তিরি মহানা আসলে ১৮৪০ সালের ওয়াইতাঙ্গি চুক্তির ব্যক্তিরূপ। প্রথম মঞ্চায়নে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ইতিহাসবিদ জুডিথ বিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার নাটকটা দারুণ হয়েছে, উইতি, কিন্তু ইচ্ছে করছিল আমাদের জন্যও যেন কোনো জায়গা থাকত।’ আমার মতে, ক্ষমাপ্রার্থনা আর পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে আগে যেতে হতো।

তবুও আপনি ঠিক বলেছেন: সাহিত্যিক দিক থেকে Pākehā মূলত প্রচলিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে অভ্যস্ত ছিল না, তখন মাওরি লেখকও বেশি ছিল না। কিন্তু আমার জীবন তো শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিকের ছিল না—আমাকে প্রকাশ্যে বর্ণবাদ আর ভয়ানক আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে, এমনকি পাবে ঝগড়া লাগাতো, যে কোনও সভায় আমাকে চেঁচিয়ে থামিয়ে দেওয়া হতো, আমাকে কেলে নিতম্ব  বলে গালাগাল দেওয়া হোত।

এসব সবই আমি তৃতীয় আত্মজীবনী Indigenous Envoy–তে বর্ণনা করব, যেখানে আমি তুলে ধরেছি কীভাবে মাওরি সাহিত্যের জন্য নতুন এক উচ্চভূমি তৈরি করা হয়েছিল। আর সেই আলাপ–আলোচনার অংশ ছিল Māori writing–কে Pākehāদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তবে  হ্যাঁ, চিনুয়া আচেবের সেই উক্তি আমার কাছে একেবারে মন্ত্রের মতো ছিল। আর কোনো বিষাক্ত বা মিথ্যা Pākehā উপস্থাপনা নয়।

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: আপনি লিখেছেন যে মাওরিরা আমাদের আখ্যানগুলোকে by way of circularities—অর্থাৎ বৃত্তাকার বা চক্রাকারে অগ্রসর হয় । আপনি কি ব্যাখ্যা করে বলতে পারেন, আপনার কাজে সেটা কীভাবে প্রতিফলিত হয়? লেখালেখি বা আখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কি কঠিন হয়ে পড়ে?”

উইতি ইহিমায়েরা: মারায়ে  বা ঐতিহ্যবাহী প্রাঙ্গণ বা অগ্নিকুণ্ড ধারার বৃত্তাকার আখ্যানে বা সর্পিল কাহিনী সহজেই চোখে পড়ে, কারণ কোরেরো  বা বর্ননা চলাকালে সবাই একজনকে উদ্দেশ্য (kaupapa) করে বা কেন্দ্রে রেখে ঘুরেফিরে কথা বলে—যতক্ষণ না ঐকমত্য তৈরি হয়। আবার অনেক সময় হয়তো ঐকমত্য হয় না, তবে আপাতত একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়—এবং সেটি ওপেন এন্ডেড বা উন্মুক্ত সমাপ্ত থাকে। এই প্রক্রিয়া ধীর, প্রত্যক্ষ নয়, প্রায়শই আড়াল-আবডাল ঘুরে আসে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই সেখানে পৌঁছে যায়।

আমার নিজের লেখার চর্চার সঙ্গে এই অভিজ্ঞতার যোগ আছে। যখন আমি আমার প্রথম উপন্যাস Tangi (১৯৭৩) এইভাবে লিখতে শুরু করি, তখন বুঝলাম পাশ্চাত্য সাহিত্যধারণা মূলত সরলরেখায় এগোয়—যা অনেকের নয়, বরং একজনের বর্ণনায় সময়ের স্রোতে এগিয়ে যায়। পাশ্চাত্য পাঠক দ্রুত গল্প চায়—অন্তত ওয়াইতুহির তুলনায় অনেক দ্রুত—এবং তাদের কাছে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছনো জরুরি। কিন্তু Tangi–তে আমি নায়ক তামা মহানার গল্প ব্যক্তিগতভাবে নয়, বরং গোষ্ঠীগত দৃষ্টিকোণ থেকে বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর যে tikanga (তিকাঙ্গা পদ্ধতি) আমি ব্যবহার করলাম, তা হলো কোরেরো–র বৃত্তাকার গঠন।

উপন্যাসে তামা ও তার বাবার তিনদিনব্যাপী অন্ত্যোষ্টি বা শ্রাদ্ধকর্ম টাঙ্গিহাঙ্গাতে  (tangihanga) অংশ নিচ্ছে, এবং সেই অন্ত্যোষ্টিই এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। তামা বারবার সেটিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে যেন । আবার সে এর সীমানা অতিক্রম করছে সময়ের নানা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে—যা তাকে একই সঙ্গে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ও ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়, চারপাশে ঘোরায় আবার ভেতর দিয়ে পারও করায়—সবচেয়ে বড় কথা, তাকে জড়িত করে তোলে সম্মিলিত স্মৃতির সঙ্গে। বইটিই যেন আক্ষরিক অর্থে কেঁদে ওঠে। আর তামার গল্পের কোনো সরলরেখার মতো, স্বস্তিকর সমাপ্তি নেই—সে কি গ্রামে থেকে খামার সামলাবে, নাকি শহরে ফিরে যাবে, সেই প্রশ্নই ঝুলে থাকে।

এই পদ্ধতিকে বোঝানোর আরেকটি উপায় হলো এক মাওরি প্রবাদ: ‘Te tōrino haere whakamua, whakamuri’—একই সময়ে সর্পিলতা সামনে এগোয়, আবার পিছনেও ফেরে; একই সঙ্গে আমাদের অগ্রসর করে, আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায়।”

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: Whānau–তে আপনি লিখেছিলেন যে, আপনি একক নায়ক বা solo protagonist–কে ঘিরে কথাসাহিত্য গড়তে অস্বীকার করেছিলেন। আজ এটি উত্তর–ঔপনিবেশিক সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেই সময়ে এটি কতটা বিপ্লবাত্মক ছিল?

উইতি ইহিমায়েরা: Whānau (১৯৭৪) ছিল আমার দ্বিতীয় উপন্যাস এবং তিন বছরে প্রকাশিত তৃতীয় বই। তাই এই তিনটির মধ্যে একটা ঐক্য আছে, যেখানে আমি আগেই বলেছি সেই tikanga পদ্ধতির আলোকে আমার লেখার চর্চাকে নির্ণয় করার চেষ্টা করছিলাম। Tangi–তে আমি একভাবে বৃত্তাকারতা (circularity) নিয়ে কাজ করেছিলাম, আর Whānau (পরিবার)–এ আরেকভাবে—এবার একক নায়ককে বাদ দিয়ে, অর্থাৎ ব্যক্তিকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়ে, ভিন্ন ধরনের এক উপজাতি–উপন্যাস লিখলাম। এইবার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হলো একটি নির্দিষ্ট স্থান—খোদাই করা গ্রামীণ মিলন–গৃহ Rongopai। বৃহত্তর বা প্রসারিত পরিবারের সদস্যরা তাকে ঘিরে ক্রমাগত আবর্তিত হয়, একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আসলে বইটির মুখ্য চরিত্র সেই মিলন–গৃহ নিজেই, আর গল্পের মানুষগুলো তার ব্যক্তিত্ব ও ইতিহাসের বিভিন্ন দিক।

সেই সময় আমি মনে করি না যে kaupapa  বা আলোচ্য উদ্দেশ্য আর tikanga পদ্ধতি এতটা বিপ্লবাত্মক ছিল—কেউ সেভাবে খেয়ালও করেনি।

তবে একজন লেখক হিসেবে সৎ হতে গেলে বলতে হবে যে, আমি তখনও সর্পিলতাকে (spiral) সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারিনি। তারা শুধু অনুভূমিক স্তরে, ভৌগোলিকভাবে কাজ করেছিল। চারদিকে ঘুরেছিল, কিন্তু ওপরের দিকে বা নিচের দিকে যায়নি—অর্থাৎ উল্লম্বভাবে, ইতিহাসের ভেতর দিয়ে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের দিকে প্রবাহিত হয়নি। সেটা ঘটল পরে, যখন আমি The Matriarch (১৯৮৬) লিখলাম। সেই উপন্যাসে সর্পিলতা ইতিহাসের ভেতর প্রবেশ করল, whakapapa  বা বংশলতিকা বা গোত্রকাহিনিতেও পৌঁছল, আন্তঃপ্রজন্মীয় মহাকাব্যের মতো একটি উপজাতীয় পরিবারের গল্প বলল। সর্পিলতা সেখানে তার আসল কাজ করতে পেরেছিল—এক উপজাতীয় নেত্রী, উপন্যাসের ‘মাতৃতান্ত্রিক’ চরিত্রটির গল্প বলা, যিনি কার্যত গোটা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেই যুদ্ধে অবতীর্ণ। আমি এখানে ইংরেজিতেই বর্ণনা করছি—এগুলো ঢুকেছিল urtext, context, pretext, textuality, intertext–এ, সবই inaianei  বা বর্তমানকে ঘিরে সর্পিল আকারে ঘুরতে থাকে। পাঠকরা এ নিয়ে আরও জানতে পারবেন Native Son (২০১৯)–এ।

তবে এই সর্পিলতার আরেকটি রূপও ছিল! আমি ধীরে ধীরে আমার সাহিত্যিক জীবন থেকেও বাইরে গিয়েছিলাম, আবার ফিরেছিলাম। আমি কূটনীতিক হয়েছিলাম, পরে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও জড়িয়েছিলাম। কারণ উপজাতীয় দাবি, জমি হারানোর প্রতিবাদ, ভাষা এবং ওয়াইতাঙ্গি চুক্তি–সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে আমি সাহিত্যিক উপন্যাসের তুলনায় সেসব কর্মকাণ্ডে অনেক বেশি কার্যকরভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম।

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: আপনি আপনার লেখায় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান সাহিত্যিকদের গুরুত্বের কথা স্বীকার করেছেন (পার্ট ২–এর শিরোনামেই Wright / Baldwin–এর প্রতি আপনার উল্লেখ তা স্পষ্ট করে)। কীভাবে আপনি সেই সাহিত্যধারার প্রতি আকৃষ্ট হলেন এবং সেই আত্মীয়তার বোধ পেলেন? আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, আমার বাবা—একজন সত্তরের দশকের লন্ডনে বসবাসকারী শ্রীলঙ্কান—ব্রুস লি আর ডিস্কোকে ভালবাসতেন, কারণ এগুলো তাঁর কাছে শক্তির সম্পর্কগুলিকে নতুনভাবে দেখার  কিংবা পুনর্গঠনের একটি বিকল্প দৃষ্টিকোণ এনে দিয়েছিল।

উইটি ইহিমায়েরা: মানুষ বুঝতেই পারে না, নিউজিল্যান্ডে সাহিত্য কতটা অত্যন্ত সাদা ছিল। ব্রিটিশ সাহিত্যের বাইরে অন্য কোনো সাহিত্যে প্রবেশাধিকার ছিল কার্যত সীমিত। অথচ আমি চেষ্টা করছিলাম আমার নিজের চর্চার জন্য সম্ভাব্য দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করতে, আর কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান সাহিত্যই হয়ে উঠেছিল সেই সম্ভাব্য দিকনির্দেশ। কেন? অন্তর্দৃষ্টি থেকে আমি অনুভব করেছিলাম, আমার এক ধরনের জাতিগত তত্ত্বনির্ভর কাঠামো প্রয়োজন।

সমস্যা ছিল, আমাদের লাইব্রেরিগুলোও ছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যে ভরা। আজকের দিনে আপনি কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের বই কয়েক সেকেন্ডেই ডাউনলোড করতে পারেন, কিন্তু ষাট–সত্তরের দশকে লাইব্রেরিতে হয়তো কয়েকটা জেমস বল্ডউইনের বই পাওয়া যেত, অথচ রিচার্ড রাইটের Native Son পড়তে আমাকে সেটা আমেরিকা থেকে অর্ডার করতে হয়েছিল—আর বইটি আসতে প্রায় পাঁচ–ছয় মাস লেগে গিয়েছিল।

আমি আদর্শ খুঁজছিলাম, অথচ এখন বুঝি আমি কতটা ভয়াবহভাবে বিচ্ছিন্ন ছিলাম—আওতেয়ারোয়ার এক রঙিন লেখক হিসেবে। আমাকে তখনও সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হয়েছিল। মনে আছে, কানাক লেখিকা ডিউই গোরোদে একবার ফ্রান্সে তাঁর ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা বলেছিলেন, আর সত্যি বলতে কী, আমার আফসোস আছে—আমি কোনো বিদেশি বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতা পাইনি, ফরাসি চিন্তাবিদদের (যেমন ফ্রান্তস ফ্যানন, মিশেল ফুকো, হোমি ভাবা প্রমুখ) সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগের অভাব ছিল। হয়তো তাঁদের মাধ্যমে আমি অনেক আগেই জানতে পারতাম বর্ণ ও সাহিত্যের সংযোগস্থলে একদম চমকে দেওয়া এবং উস্কানিমূলক চিন্তাচর্চার সেট, যা অন্যরা ইতিমধ্যেই জানত। যদিও আবার এই কথাও ভাবি—হয়তো অত তাড়াতাড়ি কাছাকাছি গেলে আমার নিজের সাহিত্যচর্চা আক্রান্ত হয়ে যেত, এবং আমাকে আওতেয়ারোয়ার নির্দিষ্ট পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত একটি মাওরি সাহিত্য রচনায় স্বাধীন থাকতে দিত না।

এদিকে, আপনার বাবার জনপ্রিয় সংস্কৃতির মাধ্যমে শক্তির সম্পর্কগুলিকে নতুনভাবে দেখার প্রসঙ্গ আমার সাথেও মেলে। আমার নিজের re-set এসেছিল কৃষ্ণাঙ্গ জনপ্রিয় সংস্কৃতির মাধ্যমেই—প্রথমে চলচ্চিত্র, সংগীত, পরে টেলিভিশন (Roots সিরিজ মনে আছে তো?)। তারপর ধীরে ধীরে কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির সঙ্গে, মার্টিন লুথার কিং ও ম্যালকম এক্সের ভাবধারার সঙ্গে, এবং কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান লেখকদের সঙ্গে সক্রিয় সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছিল। সেখানেই আমি আমার কাজে বিপ্লবী ভাবনার অনুপ্রেরণার শক্তি খুঁজে পেয়েছিলাম।

এতে আমার সাহিত্য কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে যায়নি। আদিবাসী সাহিত্য কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যের সমান নয়। কিন্তু আমি যে সব চক্রাকারে ঘোরার পদ্ধতির কথা বলেছি, তাদের বাইরের সীমানাগুলো সেই অনুপ্রেরণায় আরও গতিশীলতা ও শক্তি অর্জন করেছিল।

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: অনেক সময় দেখা যায় ‘সংখ্যালঘু’ লেখকদের সংজ্ঞা দেওয়া হয় প্রভাবশালী সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে—তাদের নিজের সংজ্ঞা নয়। অর্থাৎ, আপনাকে মাওরি লেখক হিসেবে বিচার করা হবে পাকেহা–দের ধারণা অনুযায়ী মাওরি হওয়া মানে কী, তার ভিত্তিতে, বইয়ের অন্তর্নিহিত বিষয় নয়। আপনি কি এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন? আর এটা কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া বা প্রতিক্রিয়া জানানো সহজ হয়েছে?

উইটি ইহিমায়েরা: আমি এখানে টিম উইন্টনের এডিনবরা উৎসবে বলা একটি কথাই ধার নিচ্ছি—আমরা একবিংশ শতকে বাস করছি, অথচ এখনো উনবিংশ শতকের বয়ান নিয়েই কাজ করছি। সেই গল্প পাল্টাতে হবে। এই প্রসঙ্গে আমি Penguin Random House UK–এর প্রতিশ্রুতির কথা খুব পছন্দ করি—বিশেষত তাদের নিয়োগনীতি, যা প্রকাশনার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে—যা এই পদ্ধতিগত সমস্যার সমাধানে সহায়তা করবে।

আমি যখন শুরু করি, প্রকাশকের কাছে পৌঁছানোই ছিল কঠিন, কারণ আমার সম্ভাব্য পাঠক বলে ভাবা হত মাওরি জনগণকে, আর তাদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ছিল—‘মাওরিরা বই কেনে না’। তার চেয়েও খারাপ ছিল, পাকেহারা মাওরি লেখকের লেখা, অন্তত কল্পসাহিত্য, কিনবে না। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, আমি যখন ২৮ বছর বয়সে প্রথম প্রকাশক পেলাম, পরে একজন এজেন্টও পেলাম যার সঙ্গে কথা বলা যেত—আমরা একসঙ্গে পাঠক–মহলকে ডিকলোনাইজ করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছি। নিউজিল্যান্ড সাহিত্যের মূল কাঠামো—যেমন রিভিউ, বই বিক্রেতা, ক্রেতার পছন্দ—ছিল সম্পূর্ণ একরকম, সীমাবদ্ধ মানসিকতার। তবে নিউজিল্যান্ড যখন বিকশিত হয়ে মাওরিদের অন্তর্ভুক্ত করল, আমি পাকেহা পাঠকমহলেও পৌঁছাতে পারলাম; পরে মাওরি পাঠকরাও যোগ দিল। তাই আমার সাহিত্যজীবন বেড়ে উঠেছে দেশের বেড়ে ওঠার সঙ্গেই।

গত দশকে নিউজিল্যান্ড প্যাসিফিকা লেখকদের অন্তর্ভুক্ত করায়ও উন্নতি করেছে। এখন আমাদের সংসদের প্রায় এক–তৃতীয়াংশই রঙিন মানুষ। ওয়াইতাঙ্গি ট্রাইব্যুনাল, শিক্ষা ও গণমাধ্যম এতে পার্থক্য আনছে। তবে, একই সময়ে, আমরা যদিও আন্তর্জাতিক মুসলিম বা ভারতীয় লেখকদের শুনতে উৎসবে ভিড় করি, নিজেদের দেশে গড়ে ওঠা লেখকদের যথেষ্ট সমর্থন দিই না। ভেতরের বৈচিত্র্যকে এখনও সাহিত্য–শিল্প যথেষ্টভাবে প্রতিফলিত করতে পারেনি।

তাহলে এ সময়ে কী করা উচিত? প্রথমদিকে আমার কাজকে ভুল বোঝা হত বা উপেক্ষা করা হত। আমি জানতাম, ধাপে ধাপে এগোতে হবে, চামড়া মোটা করতে হবে—বোকা ও বর্ণবাদীদের সাহায্য করা যায় না, তারা অজ্ঞ থাকলে সেটা তাদের সমস্যা। আমি এই শিল্পক্ষেত্রটা শিখেছিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি কে হব, কী প্রতিনিধিত্ব করব, এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অন্যের আরোপিত সংজ্ঞা বা বিভ্রান্তির মোকাবিলা করতে শিখেছিলাম।

তারপর নিজের পথেই এগোতে হবে। ভান শুরু করলে আপনার কাজ এমন কিছু প্রতিফলিত করতে শুরু করবে যা আপনি নন। তার চেয়েও খারাপ, আপনি এমন একজন হয়ে উঠতে পারেন যার সঙ্গে বেঁচে থাকা কঠিন হবে। আমার মাপকাঠি সহজ—যদি নিজের চোখে চোখ রেখে তাকাতে না পারেন, তবে করবেন না, যাবেন না। শেষ পর্যন্ত জয় আসে টিকে থাকার মাধ্যমে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার মাধ্যমে, এবং একটি ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আমার ক্ষেত্রে দীর্ঘ যাত্রাটাই সফলতার কারণ। একসময় দরজা খুলে যায়, মানুষ আপনাকে পড়ে, কারণ আপনি একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিচয় গড়ে তুলেছেন এবং এমন একটি পৃথিবীকে সত্যায়িত করেছেন, যেখানে পাঠক আস্থা রাখতে পারে।

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: আপনার সৃষ্টিতে মাওরি চরিত্রদের বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত। আপনাকে কখনো একক ও একরৈখিক মাওরি চিত্র উপস্থাপনের অভিযোগ করা যায় না। আমি স্টুয়ার্ট হলের সেই ধারণার কথা মনে করি—স্টেরিওটাইপ ভাঙতে গেলে ভালো/খারাপ দ্বৈততার বাইরে গিয়ে বৈচিত্র্যময় উপস্থাপন জরুরি। আপনার লেখায় কি এটা কখনো সচেতনভাবে ভেবেছেন? আর মাওরি সম্পর্কিত সমসাময়িক আলোচনার প্রেক্ষিতে কি কখনো মনে হয়েছে যে আপনাকে মাওরিদের কোনো নির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করার চাপ ছিল?

উইটি ইহিমায়েরা: ‘চক্রাকৃতি’ (circularities)–এর যে রূপকটি বলেছি, আমার মাওরি চরিত্রগুলো সেখান থেকেই এসেছে। এগুলোকে আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হয়নি, তারা নিজেরাই সেই বৃত্তের অংশ হয়ে ধরা দিয়েছে। আর ‘প্রতিনিধিত্বের বোঝা’র প্রসঙ্গে বলব—আমি সবসময় বলি, একজন মাওরি লেখক হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে Te Ao Tūroa–য়  বা প্রাকৃতিক জগৎ কিংবা জীবন্ত জগৎ প্রসঙ্গে আমাদের দুশ্চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা ও তাঁর বয়ানকে প্রকাশ করা। তাই এই দায়িত্ব কাজের সঙ্গেই আসে; এটাকে আমি বিশেষ কোনো সমস্যা বা বাড়তি চাপ হিসেবে দেখি না, আমি কেবল অনুসরণ ও পালন করি।

শুরুতে এতে কোনো জটিলতা হয়নি, কারণ আমি কাজটা এমনিই করেই গেছি, আর আমার লেখা বেশিরভাগই Waituhi valley–কে কেন্দ্র করে থেকেছে। আমার প্রথম গল্পসংগ্রহ Pounamu, Pounamu আর প্রথম দুই উপন্যাস Tangi ও Whānau—সবই সেখানকার পটভূমিতে রচিত । The MatriarchBulibashaThe Dream Swimmer, আর দুই খণ্ড আত্মজীবনীও বহু প্রজন্মের পারিবারিক কাহিনি, যার শিকড় সেই উপত্যকাতেই। আসলে আমি উইলিয়াম ফকনারের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম এই কৌশল—যেমন তিনি তাঁর লেখাকে এক কাল্পনিক কাউন্টি Yoknapatawpha–য় স্থাপন করেছিলেন। তাই আমার সবসময় মনে হয়েছে আমি সত্য লিখছি, নিজের সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকছি, আর পাঠক চাইলে আমার সুনির্দিষ্ট ‘ইহিমায়েরার  জগৎ’ থেকেই মাওরি জীবনের বৃহত্তর প্রতিচ্ছবি বুঝে নিতে পারেন।

আমার মনে হয়নি মাওরিদের কোনো বিশেষভাবে উপস্থাপন করার দায় আছে। আমার চরিত্র ও কাহিনি এসেছে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। হ্যাঁ, একজন মাওরি লেখক হিসেবে যে দায়বদ্ধতা আছে, তা ছিল, কিন্তু মাওরিদের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করার আলাদা চাপ ছিল না। সেই দায়িত্ব অন্য লেখকরা—যেমন প্যাট গ্রেস, কেরি হুলম, আপি টেলর প্রমুখরা তুলে নিয়েছেন। তবে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০–এর মধ্যে মাওরিদের রাজনৈতিক সচেতনতা দ্রুত বেড়ে যায়—যা আজ মাওরি রেনেসাঁস (Māori Renaissance) নামে পরিচিত। তখন  শুধু কথার নয়, কাজেরও প্রয়োজন ছিল। আমি হয়ে উঠলাম মাওরি লেখক ও শিল্পীদের সংগঠন গঠনের স্থপতি; হোনে তুউফারে, প্যারা ম্যাচিট্ট প্রমুখের সঙ্গে। আমি প্রথম QE2 Arts Council–এর সদস্য ছিলাম, প্রথম মাওরি আর্টস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হয়েছিলাম। প্যাট গ্রেসের সঙ্গে আমরা Te Hā Māori Writers Group শুরু করি—যার নাম আমার বাবার স্মৃতির প্রতি নিবেদিত। সে সময় আমি প্রায় দশ বছর কল্পকাহিনি লেখা বন্ধ রেখেছিলাম, কারণ সংগঠন, সম্পাদনা, আর সংগ্রামে এতটাই আনন্দ পাচ্ছিলাম। প্রথম সম্পাদিত সংকলন ছিল Into the World of Light (১৯৮২)। এরপর থেকে বারোটি সংকলন সম্পাদনা করেছি—শেষ দুটি Black Marks on the White Page (টিনা মাকারেতির সঙ্গে) এবং Pūrākau (হুইটি হেরেয়াকার সঙ্গে)। কারণ নেতৃত্ব মানে কেবল লেখা নয়, নতুন প্রজন্মকে দিকনির্দেশনাও দেওয়া। তাই বোঝা আর বোঝা থাকে না, সেটা হয়ে ওঠে উদ্দেশ্য—আর সেটা এখন অনেকের সঙ্গে ভাগাভাগি করছি ।

একই সময়ে আমি কূটনীতিক হিসেবেও নতুন জীবন শুরু করি, চলে যাই ক্যানবেরায়। তিন বছরের সেই অস্ট্রেলিয়াবাস আমার কাছে যেন আন্তর্জাতিক ‘জাতিগত সম্পর্কের’ এক প্রকার পরীক্ষাগার ছিল। সেখানেই আমার তৃতীয় উপন্যাস The Matriarch–এর বীজ বপন হয়—আদিবাসী আন্দোলন ও আমার ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সচেতনতার প্রেক্ষাপটে। অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে যখন বুলডোজার আসার আগের রাতে প্রতিবাদকারীদের পাশে বসেছিলাম, তখনই বইটির রূপ নিতে শুরু করে। পরে নিউজিল্যান্ডে ফিরে আমি জড়িয়ে পড়ি ১৯৮১–র Springbok Tour–এর আন্দোলনে। সেই বিরাট whawhai (যুদ্ধ), সেই গৃহযুদ্ধ–সদৃশ সময় থেকেই অবশেষে The Matriarch–এর জন্ম। লন্ডন রিভিউ অব বুকস–এ সি. কে. স্টিড বইটির রিভিউয়ের শিরোনামই  War Book দিয়েছিলেন।

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: আপনার প্রথম আত্মজীবনী Māori Boy (২০১৪)-তে মনে হয়েছে আপনি যেন মাওরি ও পাকেহা—দুই সমাজেই বহিরাগত ছিলেন। এটা কি আপনাকে লেখক হতে সাহায্য করেছে, যেহেতু আপনি কোনো এক সংস্কৃতির ভেতরে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ছিলেন না? আমার নিজের অভিজ্ঞতায়ও দেখেছি, আমি শ্রীলঙ্কান বা নিউজিল্যান্ডার কোনোটাই পুরোপুরি মনে করিনি—ফলে সাংস্কৃতিক কাঠামোর তথাকথিত ‘সত্য’ নিয়ে সমালোচনামূলক হতে পেরেছি।

উইটি ইহিমায়েরা: ১৯৮৬–র পর আমার জীবন এত দ্রুত এগোতে লাগল, সব দিকেই সেই বৃত্তগুলো ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকল, যে আমি বহিরাগত না হয়ে বরং একরকম boundary rider হয়ে উঠলাম—আমি সীমান্তকেই আমার স্বাভাবিক অবস্থান বানালাম। ভৌগোলিকভাবে যেমন ১৯৮৬–১৯৯০ সালের মধ্যে নিউ ইয়র্ক আর ওয়াশিংটনে ছিলাম, সেখানেই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান সংস্কৃতির প্রতি আমার ভালোবাসা আত্মার সঙ্গে মিশে গেল। সেই দূরত্ব থেকেই আমি নিউজিল্যান্ডকে নতুন চোখে দেখতে পারলাম, আর বুঝলাম—একদিকে মাওরি পিতৃতন্ত্র ও লিঙ্গবৈষম্যের নেতিবাচকতা, আর অন্যদিকে পাকেহা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ (এবং লিঙ্গবৈষম্যও)।

তারপর আমার লেখাও কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে গিয়ে নানা অক্ষ বরাবর চলতে শুরু করল। লিখলাম Nights in the Gardens of Spain (১৯৯৫), আর প্রকাশ্যে সমকামী পরিচয় নিলাম। মাওরি চরিত্রদের অপ্রচলিত পরিবেশে বসালাম—যেমন The Rope of Man (২০০৫)-এর টম ব্রকাও-স্টাইল টেলিভিশন সংবাদ উপস্থাপক—বা মাওরি প্রেক্ষাপটে অন্য ইতিহাস বসালাম—যেমন The Parihaka Woman (২০১১)-এর জার্মান পরিবার। এই সীমান্তসওয়ারের (boundary rider) রূপক যেন চূড়ান্ত রূপ পেল দুই খণ্ড আত্মজীবনী আর কিছু সাম্প্রতিক প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়, যা এখনও প্রকাশ পায়নি। আমার মনে হয়—এখন উদার আন্তর্জাতিকতাবাদ (liberal internationalism) নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে, যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক মানবতা আর kaitiakitanga (পৃথিবীর যত্ন নেওয়া) বাঁচিয়ে রাখা যায়। আত্মজীবনী আর প্রবন্ধ অনেক সময় সেই জায়গায় যেতে পারে যেখানে কথাসাহিত্য যায় না—সরাসরি আঘাতের জায়গায়।

কিন্তু প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, রঙিন মানুষ হিসেবে, কিংবা ‘অন্য’ হিসেবে, অথবা সমকামী/কুইয়ার/‘They’ পরিচয়ে—সব লেখকই নানা রকম টানাপোড়েনের ভেতর বাস করেন। প্রথমত, নিজের ভেতরে পরিচয়ের খেলা—কখন ভেতরের মানুষ, কখন বাইরের মানুষ—যা আমরা নিজেরাই গ্রহণ করি বা করতে বাধ্য হই। দ্বিতীয়ত, অন্তর্ভুক্ত/বহির্ভূত হওয়ার সেই অস্তিত্ব সংকট—যেখানে লেখক তার দেশকে নিয়ে লেখেন, আবার দেশের বিরুদ্ধেও লেখেন। যেমন, আমাকে নিউজিল্যান্ড লেখক বলা হয়, অথচ আমি সংখ্যালঘু লেখক, যে স্পষ্টতই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে লিখি—আর তবু এর জন্য পুরস্কৃত হই। আবার আমি কৃতজ্ঞ যে আমার iwi আমাকে আপন করে নেয়, কিন্তু যেহেতু আমি মাওরি সংস্কৃতি বা রাজনীতির প্রচলিত পরিসরে চলি না, তাই কারও কারও কাছে আমি যথেষ্ট মাওরি নই। তৃতীয়…আহা, ভুলে গেছি… হয়তো যৌন সত্তার ন্যায়বিচারের খোঁজ… বা লেখকসত্তা নিয়ে কিছু। লেখকসত্তার দিক থেকে বলব—আমাদের পথচলা শেষ পর্যন্ত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নিজস্ব সমালোচনামূলক অবস্থান গড়ে তোলে। স্বার্থপর হয়ে ওঠা নয়, বরং একপ্রকার নিঃস্বার্থতায় পৌঁছনোর পথে—যেখানে আপনিই ব্যক্তিগতভাবে, আর কেবল আপনার কল্পকাহিনির চরিত্র নয়—লড়াইয়ে নেমে পড়েন।

কেউ কেউ হয়তো দ্বিমত করবেন, কিন্তু আমি মনে করি লেখক নিজের ভিতরেই একটা খুঁটি গাড়েন—অথবা নিজের ভেতরেই বলেন, ‘এটাই আমার অবস্থান।’ আমরা একটা স্বাধীন সমালোচনামূলক চেতনা (বা বিবেক) গড়ে তুলি—যা অনেক সময় আমাদের একা আর অসহায় করে দেয়। এটাকে বহিরাগত হওয়া বলা যাবে না, বরং in-betweenness বলা যায়। স্বাগতম, ব্রান—এটাই দীর্ঘপথের লেখকের নিঃসঙ্গতা!

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: আপনি সবসময়ই লেখক হতে চেয়েছেন, কিন্তু আপনার আত্মজীবনীতে ছোট ছোট ঘটনাচক্রের কথা উল্লেখ করেছেন, যা আপনাকে শেষ পর্যন্ত লেখক হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে। এই ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ বা আকস্মিক ঘটনার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

উইতি ইহিমায়েরা: অসীম গুরুত্বপূর্ণ। Māori Boy আর Native Son—দুই খণ্ড আত্মজীবনী থেকেই জানবেন, আমি নিজের সঙ্গে এক যুদ্ধ করেছি—এক বিশেষ ট্রমা আর তার ফলশ্রুতিতে আত্মমূল্যের ঘাটতি ছিল। আর লেখালেখি ছিল সেই লড়াই পার হওয়ার উপায়: j’écrivis donc je devenis—“আমি লিখলাম, তাই আমি হলাম।”

পরের আত্মজীবনী Indigenous Envoy আমার জীবনের এই দারুণ ঘটনাচক্রের (magnificent accident) পথচলাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। শিরোনাম এসেছে আমার ১৬ বছরের কূটনৈতিক জীবনের দিকে ইঙ্গিত করে—যা আবার সেই চক্রাকার গতি (circularities)-রই অংশ। তবে শিরোনাম একইসঙ্গে আমার এক আদিবাসী লেখক হিসেবে বিশ্ব খাদ্য বন্টন সমস্যা, জলবায়ু ও পরিবেশ সংকট বিষয়ে সচেতনতার প্রতিফলনও। তবে অবিলম্বে যে দিগন্ত সামনে—তা হলো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের হুমকি, যা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়াচ্ছে, আর ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ক্রাইস্টচার্চে মুসলিমদের ওপর হামলায় ভয়াবহভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। নিউজিল্যান্ডে এই প্রবণতা যে কতটা অন্তর্ঘাতমূলক, তা স্পষ্ট—কারণ আমরা সবাই যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে চাইছি, তাকে নষ্ট করে দেবে।

তবে জানেন তো, এই সব আকস্মিকতা কোনো কাজে আসত না যদি আমি সেগুলো নিয়ে কিছু না করতাম। তাই আমি প্রতিটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি। লেখক ফিলিপ টেম্পল একবার (সম্ভবত ১৯৯০–এর দশকে) নিউজিল্যান্ডের এক সাহিত্যিক রাগবি টিম সাজাচ্ছিলেন—সেখানে আমাকে halfback পজিশনে রেখেছিলেন এই গুণের জন্যই। আমি ছিলাম স্ক্রামের আড়ালে স্লিপারি আর নিখুঁত ভাবে অনুকরণ করতে জানতাম।

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম:  আত্মজীবনী লেখা কতটা কঠিন ছিল? আপনি কি নিজের বা পরিবারের বিষয়ে নতুন কিছু শিখলেন? এমন জায়গায় পৌঁছে গেলেন, যেখানে যাওয়ার কথা ভাবেননি? আপনার আত্মজীবনীগুলো বেশ নগ্ন, যেখানে কল্পকাহিনির মতো কোনো ঢাকনাই নেই।

উইতি ইহিমায়েরা: আত্মজীবনী লেখা মানে যেন এই জীবনকে নিয়ে আবারও একবার যাপন করা । আমি ইতিমধ্যে সেটা দু’বার করেছি।  আত্মজীবনীর প্রতিটি অংশ লিখতে চার বছর লেগেছে; এর জন্য প্রচণ্ড ধৈর্য দরকার। দ্বিতীয় খণ্ড Native Son শেষ করার পর এখনো আমি মানসিকভাবে ক্লান্ত। তাই তৃতীয় খণ্ড কয়েক বছরের জন্য সরিয়ে রেখেছি। ভেতরের গভীর অন্ধকারে নামতে হয়—সেই যাত্রা অনেক কিছু কেড়ে নেয়: মানসিক চাপ, অনিয়মিত খাওয়া, ঘুমহীনতা, ছন্দপতন, স্বপ্নের ভেঙে যাওয়া। প্রথম আত্মজীবনীতে যত গভীরে গিয়েছিলাম, দ্বিতীয় খণ্ডেও ততটাই যেতে হল। সেই প্রক্রিয়ায় অগণিত বিষয় বেরিয়ে এসেছে, আরও অনেক কিছু তৃতীয় খণ্ডে বের হবে।

ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গম: আত্মজীবনীতে আপনি অন্ধকার দিকের মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু একইসঙ্গে এটাকে ফলপ্রসূও করেছেন। বইগুলোতে বহুস্তরীয় সুর আছে। নিজের কাজকে আবার পর্যালোচনা করার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?

উইতি ইহিমায়েরা: আপনার বলা ‘rich polyphony’  বা বহুস্তরীয় সুর কথাটা আমি পছন্দ করলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন, আত্মজীবনীগুলো শুধু ব্যক্তিগত প্রকাশ নয়। প্রথম খণ্ডটি Māori শৈশবের কাহিনি—যা উদার, গোত্রকেন্দ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এক জগতের গল্প। দ্বিতীয় খণ্ডটি লেখক হয়ে ওঠার লড়াইয়ের গল্প—পশ্চিমি ঐতিহ্যের সঙ্গে Māori চেতনার সংঘাত আর আলোচনার মাধ্যমে পথ তৈরি করার প্রক্রিয়া।

আমি প্রায়ই নিজের কাজের পুনর্লিখন করেছি—Pounamu, PounamuTangi / The Rope of ManWhānau / Whānau IIThe Matriarch / Redux–এর নানা সংস্করণ, আবার নাটক-সিনেমার রূপান্তর। আমি আসলে কাজগুলোকে তার কেন্দ্রের দিকে আরও টেনে আনতে চাই। Native Son–এ শিক্ষণধর্মিতা (didacticism) এসেছে কারণ আমি চেয়েছিলাম পাঠকরা আমার পদ্ধতিটা বুঝতে পারুক—যেখানে kaupapa আর tikanga–এর মতো Māori নীতি-প্রথা অদৃশ্য দুই-তৃতীয়াংশকে ধরে রাখে, যাতে দৃশ্যমান এক-তৃতীয়াংশ ভেসে উঠতে পারে এবং আমার স্বাক্ষরমূলক moko বহন করে।

অনেকখানি Māori পুরাণও ঢুকিয়েছি, যাতে বোঝা যায় কিভাবে ভিন্ন এক মিথভিত্তি কেন্দ্রে আসতে পারে এবং পশ্চিমি টেক্সটকে প্রান্তে সরিয়ে দিতে পারে। আমার লক্ষ্য ছিল শুধু আত্মকথা লেখা নয়—এক ধরনের লেখক–মেনিফেস্টো তৈরি করা। স্মৃতিকথাই ছিল সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সর্বোত্তম মাধ্যম।

জ্যানেট ফ্রেম বলেছিলেন—স্মৃতির আসল শক্তি লেখার মুহূর্তেই ফিরে আসে। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। Māori দৃষ্টিকোণ থেকে, চার বছরের প্রতিদিন নিজেকে বসিয়ে লেখা—এটাই আমাকে Māori–দের  শক্তির কাছে খুলে দিয়েছে।  হল সেই শক্তি যা Te Kōre (আদি শুন্যতা) থেকে উৎসারিত হয়ে Te Pō (আদি রাত) আর Te Ao (আদি দিন) জুড়ে প্রবাহিত। সেই শক্তি যেন অনর্গল ঝরে পড়ছিল আমার স্মৃতিতে। আর আমার চার বোন, পুরো whānau–র যৌথ স্মৃতি সেটাকে সমর্থন করছিল।

শেষে আমি আশা করি, যে ছোট্ট ছেলেটি একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল সংস্কৃতিকে দেশের চেয়ে অগ্রাধিকার দেবে – তার কাছে আমি যোগ্য জবাব দিতে পেরেছি। আমি তাকে মনে মনে কল্পনা করি যে সে উল্লাসে ফেটে পরে লাফাচ্ছে আর বলছে, “আমরাও পেরেছি।” 

হ্যাঁ, আমার ভেতরের বহু অন্ধকার বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু একইসঙ্গে বেরিয়ে এসেছে আমাকে বাঁচিয়ে রাখা আলো—আমার বাবার গভীর ভালোবাসা, বহু দিদিমার স্নেহ, আর লেখার প্রবল টান—যা আমাকে জীবনের মানে দিয়েছে, শেখা জিনিসগুলো ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে, আর নিজেকে মুক্ত করার পথ দিয়েছে।

Facebook
Twitter
LinkedIn

Letest Cover Stories

লক্ষ্মী এলেন

আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। শরতের আকাশে জ্বলজ্বল করবে পূর্ণচন্দ্র, বাংলার ঘরে ঘরে হবে আজ লক্ষ্মীপূজা। ধানের শীষ, প্রদীপের আলো, দুধ-চালের পায়েস, আর কাঁসার থালায় সাজানো ফলমূল—এইসবের

Read More »

তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে দেবী দুর্গা  

ড.পি.অনুরাধা  ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে দেবী দুর্গা এক বহুমাত্রিক প্রতীক। তিনি যেমন পুরাণে মহিষাসুরমর্দিনী, তেমনি গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিতে অন্নদাত্রী মাতৃরূপে বিরাজমান। সংস্কৃত সাহিত্যে দুর্গাসপ্তশতী (মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ) তাঁর পূজার

Read More »

Privious Cover Stories

লক্ষ্মী এলেন

আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। শরতের আকাশে জ্বলজ্বল করবে পূর্ণচন্দ্র, বাংলার ঘরে ঘরে হবে আজ লক্ষ্মীপূজা। ধানের শীষ, প্রদীপের আলো, দুধ-চালের পায়েস, আর কাঁসার থালায় সাজানো ফলমূল—এইসবের

Read More »

তামিল ও তেলেগু সাহিত্যে দেবী দুর্গা  

ড.পি.অনুরাধা  ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে দেবী দুর্গা এক বহুমাত্রিক প্রতীক। তিনি যেমন পুরাণে মহিষাসুরমর্দিনী, তেমনি গ্রামীণ লোকসংস্কৃতিতে অন্নদাত্রী মাতৃরূপে বিরাজমান। সংস্কৃত সাহিত্যে দুর্গাসপ্তশতী (মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ) তাঁর পূজার

Read More »

বৃত্ত পথের পরিক্রমায়

নিউজিল্যান্ডের মাওরি সাহিত্যিক উইতি ইহিমায়েরার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত কিউই লেখক ও আইনজ্ঞ ব্রানাভান জ্ঞানলিঙ্গমের আলাপচারিতা । অনুবাদ করেছেন নবকুমার দাস।  উৎস : সিডনি বুক রিভিউ

Read More »