চন্দ্রিকা জয়সুধা
কখনও কখনও একটি মুহূর্তই হয়ে ওঠে ইতিহাসের নতুন এক সূচনা। ২০২৫ সালের মে মাসে লন্ডনের টেট মডার্নের ঝলমলে সন্ধ্যায় তেমনই এক মুহূর্ত রচনা করেছিল, যখন আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের ঘোষণায় উচ্চারিত হল কন্নড় ভাষার এক নারীর নাম—বানু মুস্তাক। তাঁর গল্পসংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’ এবং এর ইংরেজি অনুবাদক দীপা ভাস্তি যৌথভাবে পেলেন বিশ্বসাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মানগুলির একটি। এটি কেবল একজন লেখিকার প্রাপ্তি নয়, বরং গোটা কন্নড় ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিক সাফল্য।

বানু মুস্তাক ১৯৪৮ সালে কর্ণাটকের হাসান শহরে জন্মেছেন । জন্মসূত্রে তাঁর মাতৃভাষা উর্দু হলেও স্কুলজীবনে তাঁকে আয়ত্ত করতে হয়েছিল কন্নড় ভাষা। প্রথমে যে ভাষা ছিল প্রায় অচেনা, ধীরে ধীরে সেটিই হয়ে উঠল তাঁর প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। কৈশোর থেকেই লেখালেখির ঝোঁক থাকলেও ছাব্বিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় , প্রজামাতা নামের এক কন্নড় পত্রিকায়। তিনি সামাজিক প্রথার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন । এই ব্যক্তিগত সাহসই যেন তাঁর সাহিত্যিক যাত্রার ভিত্তি রচনা করেছিল।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন আইনজীবী, দীর্ঘদিন সাংবাদিকতাও করেছেন, আবার পৌরসভার কাউন্সিলর হিসেবেও কাজ করেছেন। এই নানান অভিজ্ঞতার পরিসরই তাঁকে দিয়েছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর গল্পে ও লেখালিখিতে। আদালতের বিতর্ক, সংবাদপত্রের অন্দরমহলের বাস্তবতা কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনের রাস্তাঘাট ময়দান—সবই তাঁর সাহিত্যকে রসদ দিয়েছে । তাঁর গল্পে বারবার ফিরে এসেছে মুসলিম নারীর দৈনন্দিন সংগ্রাম, সমাজ ও ধর্মের অদৃশ্য বাঁধন, জাতপাতের শৃঙ্খল, আর ব্যক্তিস্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। তিনি যে শুধু বর্ণনাকারী নন, বরং প্রত্যক্ষদর্শী ও সহমর্মী, তা তাঁর প্রতিটি রচনাতেই সুস্পষ্ট।
‘হার্ট ল্যাম্প’ সংকলনে ১৯৯০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ের বারোটি গল্প একত্রিত হয়েছে। এগুলো বড় কোনো নাটকীয় ঘটনায় সম্পৃক্ত নয়, বরং সাধারণ নারীর জীবনকথা, নীরব ক্ষোভ ও ছোট ছোট বিদ্রোহেই রচিত। রান্নাঘরের ধোঁয়া, প্রার্থনার মাদুর, কিংবা আড়ালে জমে থাকা নীরব অশ্রু—সবকিছুই এখানে রূপ নিয়েছে সাহিত্যে। অনুবাদক দীপা ভাস্তি কন্নড় ভাষার স্বাদ ও ছন্দ নিখুঁতভাবে রক্ষা করেছেন ইংরেজি রূপান্তরে। আন্তর্জাতিক বুকার জুরি তাই মন্তব্য করেছেন, এই গল্পগুলো একাধারে অন্তরঙ্গ ও সার্বজনীন, এবং এদের আবেগীয় শক্তি অসাধারণ।
কিন্তু এই সাহিত্যিক সাফল্যের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। নারীর অধিকার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে তাঁর অবস্থান তাঁকে বারবার বিতর্ক ও বিরোধিতার কেন্দ্রে এনেছে। হিজাব নিয়ে প্রকাশ্য মতামত, মহিলাদের মসজিদে প্রবেশাধিকারে সমর্থন, কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান—এসবই তাঁকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছে । কখনও হুমকি, কখনও বয়কট, এমনকি সহিংসতার আশঙ্কাও তাঁকে ঘিরেছে। সম্প্রতি মাইসোর দশরা উৎসবের উদ্বোধক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হলে আদালত পর্যন্ত বিতর্ক গড়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত জানায়, সাংস্কৃতিক জীবনে তাঁর এই অংশগ্রহণ অস্বীকার করার অধিকার কারও নেই।
সব প্রতিকূলতার মধ্যেও বানু মুস্তাক অটল থেকেছেন। তাঁর লড়াই শুধুমাত্র স্বর চড়ানো নয়, বরং স্থির ও ধৈর্যের—যেন প্রদীপের শিখা, যা বাতাসে দুলে উঠলেও নিভে যায়না। আর এই প্রদীপই আজ আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গনে আলোকিত করছে কন্নড় সাহিত্যকে। একটি ভীষণভাবে ভারতীয় সাহিত্যকে। এই জয় টিকা শুধুমাত্র কন্নড সাহিত্যের নয়, বৃহত্তর অর্থে ভারতীয় সাহিত্যের।
এই সাফল্যের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমবার কোনো কন্নড় লেখক আন্তর্জাতিক বুকার পেলেন, প্রথমবার কোনো ছোটগল্প-সংকলন এই স্বীকৃতি অর্জন করল, আর দীপা ভাস্তি প্রথম ভারতীয় অনুবাদক হিসেবে পুরস্কৃত হলেন। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া যথার্থই বলেছেন—“তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে কন্নড় সাহিত্যের পতাকা উড়িয়েছেন।”
আজ বানু মুস্তাক আর কেবল একজন লেখিকা নন, তিনি প্রতীক—বিলম্বিত স্বীকৃতির, নারীর কণ্ঠস্বরের, আঞ্চলিক সাহিত্যকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দেওয়ার। সাতাত্তর বছর বয়সে তিনি প্রমাণ করেছেন, শিল্পের বয়স নেই, সাহসেরও নেই কোনো সীমা। হার্ট ল্যাম্প শুধু একটি গল্পসংকলন নয়, এটি সেইসব নারীর স্মারক, যাঁরা এতদিন ছিলেন আড়ালে, নীরবে।
হয়তো এটাই তাঁর প্রকৃত অর্জন—ক্ষুদ্র জীবনের সাধারণ কাহিনিকে তিনি রূপ দিয়েছেন বিশ্বজনীন আলোর প্রদীপে।


