নবকুমার দাস
মাইকেল মধুসূদন দত্তের দি ক্যাপটিভ লেডি ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাজমোহন’স ওয়াইফ ইংরেজি ভাষায় বাঙালি লেখকের দুই প্রারম্ভিক সাহিত্য সৃজন – তৎকালীন ঔপনিবেশিক আধুনিকতা, ভাষার রাজনীতি ও বর্ণনাশৈলীর তুলনামূলক পাঠ করার চেষ্টা করছি এই লেখায়। এটা একান্ত ব্যক্তিগত দৃষ্টি এবং আমার মতটিই একমাত্র দৃষ্টিকোণ তা হতে পারেনা ধরেই এই লেখার ছোট্ট দুঃসাহস। সচেতন পাঠক-পাঠিকার কাছে আমার এই চেষ্টার জন্য প্রথমেই মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি।
বাংলা নবজাগরণের দুই মহীরুহ যথাক্রমে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪–১৮৭৩) ও সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৮৯৪) দুজনেই তাঁদের সাহিত্যজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় কলম ধরেছিলেন। ঠিক যেমনটি সাম্প্রতিক অতীতে আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। মাইকেল মধুসূদনের The Captive Ladie একটি উচ্চাঙ্গের বর্ণনামূলক কবিতা অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের Rajmohan’s Wife ভারতীয় লেখকের লেখা প্রথম ইংরেজি উপন্যাস বা সাহিত্যিক নিদর্শনের অন্যতম । উভয় রচনার পশ্চাতে আছে ঔপনিবেশিক শিক্ষার প্রসার, ইংরেজি পাঠ্যক্রমের প্রভাব এবং তৎকালীন “বাবু সংস্কৃতি” বা “ভদ্রসমাজের” আত্ম-পরিচয়ের সন্ধান। তবে এই আলোচনায় দু’জনের সৃজন-ব্যাকরণ আলাদা আলাদা। দুটির একটি মহাকাব্যিক ঘরানার ঐতিহাসিক রোমান্স, অন্যটি সমাজবাস্তবতার গদ্যাকারে নির্মিত পারিবারিক-আইনি থ্রিলারসদৃশ কাহিনি। তুলনামূলক পাঠ তাই জরুরি, কারণ এর ভিতর দিয়ে দেখা যায়—ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বীক্ষায় বাঙালি সাহিত্যিকের প্রকাশভঙ্গি কীভাবে ভাষা, বর্গ, লিঙ্গ, নৈতিকতা ও নন্দনে ভিন্ন ভিন্ন রেখা টানে (S. K. Das 1991; Rosinka Chaudhuri 2002; Meenakshi Mukherjee 2000)।
এই প্রবন্ধটি চারটি স্তরে লেখা হল, প্রথমতঃ ঐতিহাসিক-আত্মপরিচয়ের প্রেক্ষাপট, দ্বিতীয়তঃ পাঠবস্তুর সূক্ষ্ম তুলনামূলক বিশ্লেষণ- কাহিনি, চরিত্র, সময়-চেতনা ও নন্দনরীতি, তৃতীয়তঃ ভাষা-রাজনীতি বা ইংরেজিতে লেখার কারন , কৌলীন্য ও সীমা, এবং চতুর্থতঃ উত্তরাধিকার ও প্রভাব—বাংলা সাহিত্যে প্রত্যাবর্তন ও ভবিষ্যৎ ধারার গঠন। শেষে রাখছি একটি সংযত উপসংহার এবং সংশ্লিষ্ট গ্রন্থপঞ্জি।
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় মেকলের ধ্বজাধারী ইংরেজি শিক্ষানীতির (Minute on Education, 1835) ফলশ্রুতিতে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি -হিন্দু কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান ইংরেজি পাঠের মাধ্যমে এক নতুন মেধাবী যুবসমাজ সৃষ্টি করে। এই সমাজ নিজেদের পরিচয় ‘ইম্পেরিয়াল স্যান্ডার্ড বা সাম্রাজ্যের মানদণ্ড’-এ যাচাই করতে চায়। ইংরেজি ভাষা তখন কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক পুঁজি যা একজন সৃজনশীল লেখক ও সাহিত্যিকের কাছে এক “উচ্চতর” নান্দনিক চাবিকাঠি (Viswanathan 1989)। মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্র উভয়েই এই বাস্তবতার সন্তান।এই বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই।
মধুসূদন নিজের কাব্য-প্রয়াসে ইউরোপীয় মহাকাব্য-আদর্শের অনুকরণে এক ‘আন্তর্জাতিক’ উচ্চতা ও উজ্জ্বলতায় পৌঁছতে চাইছিলেন; অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি গদ্যে “আধুনিক উপন্যাস” রচনায় হাত পাকাতে চাইছিলেন—পরে অবশ্য তিনিই বুঝতে পারেন, মাতৃভাষাই তাঁর সাধারণ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ ক্ষেত্র (Mukherjee 2000; Amiya P. Sen 2011)।
দি ক্যাপটিভ লেডি (বন্দিনী? ) বা The Captive Ladie (১৮৪৯) এমন সময়ে প্রকাশিত হয় যখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ভারতীয় তথা বাঙালির ঐতিহ্যকে পাশ্চাত্যের নন্দনতাত্বিক ছাঁচে পুনর্গঠন করছেন। তাঁর কাব্যের উপজীব্য মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাস যা স্থল পুরাণ গোত্রীয় ; কাব্য ভাষা অনেকবেশি অলঙ্কৃত, এবং জন মিলটন ও লর্ড বায়রনের দ্বারা প্রভাবিত।
অন্যদিকে Rajmohan’s Wife (রাজমোহনের স্ত্রী ? ) ইন্ডিয়ান ফিল্ড পত্রিকায় ১৮৬৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে ; এই কাহিনির প্রেক্ষাপট তৎকালীন অখণ্ড বাংলা প্রদেশ বা বেঙ্গল প্রভিন্স। বঙ্কিমচন্দ্র তখন সদ্য সরকারি আমলা বা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছেন এবং ইংরেজি রচনায় তাঁর সাবধানী প্রবেশ ঘটেছে কিন্তু বিষয়বস্তু একান্তই দেশীয় সমাজ-বাস্তবতায় সম্পৃক্ত । তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে আর্থ-সামাজিক-আইনি সংকট ও নারীর দুর্দশা তিনি এই উপন্যাসে ব্যক্ত করলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লিখিত এই উপন্যাসটি সাধারণত ইংরেজি ভাষায় রচিত ভারতের প্রথম উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত কিন্তু বিশিষ্ট সমালোচক ও বুদ্ধিজীবী মকরন্দ পরাঞ্জপের মতে রাজমোহন’স ওয়াইফ সমগ্র এশিয়ারই প্রথম ইংরেজি উপন্যাস। উপন্যাসটি রোম্যান্স ও অ্যাডভেঞ্চারের ছকে নির্মিত—যেখানে রহস্য ও উৎকণ্ঠার উপাদান, গোপন সাক্ষাৎ, সামন্ততান্ত্রিক জটিলতা, চুরি–ডাকাতি, অপহরণ এবং প্রেম ইত্যাদি মিলেমিশে গেছে—তবুও এই উপন্যাসের প্রধান বা নায়িকার চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক আধুনিক নারীর অনুভূতি ও আবেগকে এক অপূর্ব রূপে চিত্রিত করেছেন। এর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে বাংলার এক পুরনো, সামন্ততান্ত্রিক, গ্রামীণ পরিবেশের পটভূমিতে। এইভাবে উপন্যাসের নায়িকা একজন দৃঢ়চেতা ও বলিষ্ঠ চরিত্রে পরিণত হয়েছেন, যিনি নির্ভয়ে নিজের প্রেম ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন; কিন্তু তিনিও শেষাবধি তাঁর প্রাপ্য ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।
অন্যদিকে মাইকেল মধুসূদনপ্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও কিংবদন্তি-গাথাকে আধুনিক ইংরেজি বর্ণনামূলক কবিতার অবয়বে গড়ে তুললেন । মধ্যযুগের কানৌজ-দিল্লির ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বা ‘Feast of Victory’, রাজকন্যার বন্দিত্ব, নায়কের ছদ্মবেশে উদ্ধার—সব মিলিয়ে এক রোমান্টিক-নাটকীয় আখ্যান পরিবেশিত হল । এটি সরলরৈখিক , কিন্তু মহাকাব্যিক সুর আখ্যানকে “উচ্চাঙ্গের” প্রতীকে পরিণত করল । কাহিনি আধুনিকতার শুরুতে জাতিসত্তার একটি প্রতীকি পাঠও দেয়—বন্দিনীর মুক্তি যেন দক্ষিণ এশিয়ার স্বাতন্ত্র্যের আলংকারিক ইঙ্গিত (Das 1982)।
অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর Rajmohan’s Wife– উপন্যাসে গ্রামীণ বাঙালি সমাজকে তাঁর কাহিনির কেন্দ্রে নিয়ে আসেন । যে কাহিনির মুলে পারিবারিক নিগ্রহ, নৈতিক দ্বন্দ্ব, আইনি জটিলতা, এবং মতঙ্গিনীর সাহসী সিদ্ধান্ত ইত্যাদি বর্ণিত হয় যাকে একধরনের ‘ডোমেস্টিক থ্রিলার’ বলা যায় । তবে এখানে আধুনিক উপন্যাসের ক্লাসিক বা ধ্রুপদী উপাদান যেমন সংলাপ, বর্ণনা, প্লট-টুইস্ট, চরিত্রের নৈতিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সবই আছে, যদিও ইংরেজি বাক্য-প্রকরণে কোথাও কোথাও আড়ষ্টতা লক্ষিত হয় । কিন্তু দেশজ সমাজ-বাস্তবতার প্রথম সাহসী সন্নিবেশ এটিকে ঐতিহাসিকভাবে অনন্য করেছে (Mukherjee 2000)।
পারস্পরিক তুলনা করলে আমরা দেখব যেমাইকেল মধুসূদনের Captive Ladie যেন ঐতিহাসিক রোমান্সের রাজকীয় পুনর্লিখন অন্যদিকে বঙ্কিম চন্দ্রের Rajmohan’s Wife—বাস্তবসমাজ-নির্ভর, প্রোটো-রিয়্যালিস্ট গদ্য। প্রথমটি “উচ্চস্বরে” পাশ্চাত্যের মহাকাব্যের আভাষ দেয় অন্যদিকে দ্বিতীয়টি খুব স্বাভাবিক বাস্তবতায় “গৃহস্বরে” সমকালীন সমাজজীবনের অন্তঃসত্য তুলে ধরে।
মধুসূদনের সময়-চেতনায় “ অতীত গৌরব”—প্রাচীন রাজকাহিনি ও গাথা কাহিনিকে আধুনিক রাজনৈতিক নান্দনিকতায় উত্তরণ ঘটিয়েছেন (Chaudhuri 2002)। তাঁর লেখায় বীরত্ব, প্রেম, আর্চেটাইপিক নায়ক-নায়িকা, এবং ‘উদ্ধার’-কেন্দ্রিক মোক্ষপাঠ পরিলক্ষিত হয় । অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের সময়-চেতনায় “সমাজ-সংস্কার”- সমাজে নারীর অবস্থান , বিবাহপ্রথা, সম্পত্তির দ্বন্দ্ব , আমলাতন্ত্র, স্থানীয় ভদ্রসমাজের আচরণবিধি। এখানে ‘আধুনিকতা’ মানে আইনি-নৈতিক জটিলতার জায়গা—ব্যক্তি বনাম বিধি।
আমরা দেখতে পাই যে Captive Ladie-এর চরিত্রগুলি মূলত আরোপিত ও আদর্শায়িত—তাঁরা প্রতীকী যেমন নায়ক ,নায়িকা ,অত্যাচারী (hero/heroine, tyrant, troubadour-রূপী উদ্ধারক)। তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা নয়, বরং প্রতীকি ভূমিকা মুখ্য।
Rajmohan’s Wife-এ মতঙ্গিনী, রাজমোহন, মথুরা—সবাই ব্যক্তি; তাঁদের ভয়, লোভ, আকাঙ্ক্ষা, নৈতিক দ্বিধা—সবই দৃশ্যমান। বিশেষত মতঙ্গিনী বাঙালি কথাসাহিত্যের সূচনালগ্নের এক শক্তিশালী নারীচরিত্র—যিনি আবার ইংরেজি গদ্যে প্রথম ভারতীয় নারীর অন্যতম প্রতিনিধি।
ক্যাপটিভ লেডির সংযুক্তা অর্থাৎ মধুসূদনের বন্দিনী-নায়িকা মূলত আদর্শায়িত রূপক—মুক্তির প্রতীক; তাঁর কণ্ঠস্বর আখ্যানের ‘মোক্ষবোধ’-এ মিশে যায়। নাটকীয়তায় এই নারী যেন আবেগের ক্ষেত্র, কিন্তু তাঁর স্বতন্ত্র প্রকাশ সীমিত বা উন্মোচিত হয়না। অন্যদিকে বঙ্কিমের মতঙ্গিনী ব্যক্তি স্বরূপা তিনি ভিক্টিম হতে হতে সক্রিয় স্বাতন্ত্রতায়পৌঁছান ; সিদ্ধান্ত নেন, বিরোধিতা করেন, ঝুঁকি নেন। ঔপনিবেশিক বাংলায় এটি এক স্মরণীয় দ্যোতনা (Mukherjee 2000; Sen 2011)।
The Captive Ladie-তে দীর্ঘ পারিওডিক বাক্য, ইনভার্সন, উদ্ধৃতি (বাইবেল ও ধ্রুপদী ), উচ্চারণে ‘মহাকাব্যিক উচ্চতা’—সব মিলিয়ে ইউরোপীয় মহাকাব্য-রীতির অনুকৃতি ও আত্মীকরণ। এটি যেন এক সচেতন উচ্চারণ যে ‘আমিও পারি’—এক ঔপনিবেশিক বিধিবদ্ধ বিশ্বে বাঙালি কবির আত্মপ্রত্যয়ের প্রতিভাস (Das 1982; Chaudhuri 2002)।
বঙ্কিমের ইংরেজি বাক্য গঠন কখনো প্রাঞ্জল বা সচল নয় ; তবু বর্ণনা, প্লট, সংলাপ, দৃশ্য-সংবেদন ও মুড—সবই গদ্যধর্মে প্রোথিত। তবে এই উপন্যাসটি পাঠের মধ্যে ‘দেশজ’ শব্দভঙ্গীর ছাপ চোখে পড়ে; অনেক স্থানেই বাংলাভাষার বাক্যগঠনের বা সিনট্যাক্সিক ছায়া আছে । এই টেক্সট পরে বঙ্কিমকে বাংলায় ফিরিয়ে আনে; সেখানে তাঁর গদ্য স্বকীয় সুভাষে বিকশিত হয় (Mukherjee 2000)।
মধুসূদনের কাব্যিক সত্ত্বা বা বক্তা প্রায়-অলিম্পিয়ান অর্থাৎ তিনি সর্বজ্ঞ, ঘটনাক্রমের উপর দিয়ে এক উচ্চতর বর্ণনা চালান।তবে আধুনিক ভাষ্যে এই অবস্থানকে আমরা এগালেটেরিয়ান বা সর্বময় উপস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করতে পারি।
বঙ্কিমের উপন্যাসে সর্বজ্ঞ কথকের পাশাপাশি চরিত্রমূলক ফোকালাইজেশন (মতঙ্গিনীর দৃষ্টিরেখা) তৈরি হয়; ফলত সহানুভূতির লেন্স বদলায়, উত্তেজনা জমে। এটি উপন্যাস-কৌশলের সূক্ষ্ম চর্চা, যদিও ইংরেজি ভঙ্গি কোথাও টলমল। মধুসূদনের এই কাহিনির উৎস রাজসূয়-উৎসব, দিল্লির রাজা, বন্দিনী রাজকন্যা, ভাটের ছদ্মবেশ ইত্যাদি সবই মধ্যযুগীয় ভারতকথা। ইংরেজি কাব্যে এটি নতুন আত্মপ্রতিমা নির্মাণ—ঔপনিবেশিক বঙ্গের কবি যথার্থভাবে ‘ইন্ডিক এপিক’-এর কণ্ঠে বিশ্বসাহিত্যে প্রবেশ করছেন। এতে ‘জাতি-চেতনা’ এক অস্পষ্ট প্রতীকি মনে হয় , শত্রুমুক্তির স্বপ্ন, সম্মানের প্রতিদান (Das 1991; Das 1982)।
অন্যদিকে Rajmohan’s Wife গ্রামীণ বাঙলার সামাজিক কাঠামোকে দৃশ্যমান করে—পিতৃতন্ত্র, সম্পত্তি, আমলাতন্ত্র, নৈতিকতা, গোপন হিংসা ইত্যাদির । উপন্যাস ‘ঘরের ভিতরের’ আধুনিক বাস্তবতাকে চিহ্নিত করে—ব্যক্তির অধিকার, বৈবাহিক সম্পর্কের টানাপোড়েন , নারীর দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি প্রতিভাত হয় । The Captive Ladie ও Rajmohan’s Wife—দুটিই ইংরেজি ভাষায় রচিত ভারতীয় লিখনের সূচনা স্তম্ভ। প্রথমটি কাব্য এবং দ্বিতীয়টি উপন্যাস; উভয়েই ভারতীয় উপাদানকে ইংরেজি ভাষায় সঞ্চালিত করছে। ক্যানন-রচনার ইতিহাসে এই টেক্সটগুলি প্রমাণ—প্রথম ভারতীয়-ইংরেজি লেখকরা একদিকে ইউরোপীয় নন্দন-ব্যকরণ রপ্ত করছেন, অন্যদিকে দেশজ বিষয়কে স্থাপন করছেন (Mukherjee 2000)।
শিল্প-সার্থকতা ও ভাষাগত জড়তা, পাঠ্যপুস্তক-ভিত্তিক ক্যাননের ইউরোপীয় প্রাচুর্য—সব মিলিয়ে এই টেক্সটগুলো এখন প্রান্তিক রচনা । বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় মধুসূদন-বঙ্কিমের বাংলা রচনা গুলিই পাঠ-অর্থনীতিতে মুখ্য হয়ে উঠেছে; ইংরেজি রচনাগুলি ‘ঐতিহাসিক দলিল’ হয়েই থেকে গেছে । তবু সাম্প্রতিক উপনিবেশ-উত্তর সাহিত্যবীক্ষায় এদের গুরুত্ব ফের আলোচিত (Chaudhuri 2002; Sen 2011) হচ্ছে । সম্প্রতি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সুগত সামন্তর একটি গবেষণাপত্রে বঙ্কিমের মাতঙ্গিনীকে ও ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় শর্বরী সিনহার একটি নিবন্ধ মাইকেলের ক্যাপটিভ লেডি সম্পর্কে বিশেষ দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।
তবে পারস্পরিক তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই যে মধুসূদন প্রাচীন গৌরব-রোমান্সে জাতিমন নির্মাণ করেন; বঙ্কিম গৃহ-সমাজে আধুনিকতার সংকট দেখান। সংযুক্তার বন্দিনী-মোক্ষের রূপক বনাম মতঙ্গিনীর ন্যায়সংগ্রাম। Captive Ladie-তে ‘নেশন’-এর প্রতীকি নির্মাণ ঘটেছে অন্যদিকে Rajmohan’s Wife-এ ‘হোম’-এর নৈতিকতা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে । প্রথমটি টনিক উচ্চারণ, অলিউশন; দ্বিতীয়টি প্লট, সংলাপ, ফোকালাইজেশন। একদিকে মহাকাব্যিক ডিকশন, অন্যদিকে অন্তর্গত উত্তেজনার গদ্য।মধুসূদনের ইংরেজি অলঙ্কার-সমৃদ্ধ; বঙ্কিমের গদ্য হিসেবি, কাহিনির প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। মাইকেলের কাব্যে অক্সিডেন্টাল রেফারেন্স অন্যদিকে বঙ্কিমের এই ইংরেজি ভাষার উপন্যাসে আমরা দেখি বাংলাভাষার ছায়া। প্রভাবগত তুলনা করলে আমরা দেখব মধুসূদন তাঁর বাংলা মহাকাব্য (মেঘনাদবধ কাব্য)-র পূর্বভূমি বা প্রস্তুতিক্ষেত্র হিসেবে ভারতীয় উপাদান সমৃদ্ধ ইউরোপীয় আখ্যান-প্রযুক্তি আত্মীকরণের রিহার্সাল করেছেন এই কাব্যে। আবার বঙ্কিমচন্দ্রএই উপন্যাসেই যেনতাঁরবাংলা উপন্যাসের ভিত; বিশেষ করে দুর্গেশনন্দিনী থেকে থেকে আনন্দমঠ সবখানেই Rajmohan’s Wife-এর বাস্তববাদী উদ্বেগের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় (Sisir Kumar Das 1991; Sen 2011)।
মধুসূদনের “Captive Ladie”শৌর্য,প্রেম ও মুক্তির রূপক; তিনি বড়ো ক্যানভাসে প্রতীক। কাব্য-উচ্চারণে নারীর কণ্ঠস্বর আবেগ-উদ্দীপনার বাহক হলেও সিদ্ধান্ত-নির্ধারক নয়। কিন্তু বঙ্কিমের মতঙ্গিনী—নারীর মন -রাজনীতি, নৈতিক সিদ্ধান্ত, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা—সবকিছু টপকে বেঁচে থাকার পথ খোঁজে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘ভদ্রসমাজে’ তিনি এক ব্যতিক্রমী কণ্ঠ (Mukherjee 2000)।
ক্যাপটিভ লেডির সংযুক্তা বা বন্দিনী-নায়িকা যেখানে ‘জাতীয়-আকাঙ্ক্ষার’ প্রতীক, মতঙ্গিনী সেখানে ‘ব্যক্তিগত-স্বাধীনতার’ নিরন্তর সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে । এই ভিন্নতার ভিতরেই দুই টেক্সটের ঐতিহাসিক-আদর্শগত প্রকৃতি ধরা পড়ে। The Captive Ladie প্রকাশের সময় মধুসূদনের ইংরেজি প্রতিভা আলোচিত হলেও, বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসল কৃতিত্ব ধরা পড়ে পরে বাংলা মহাকাব্য, নাটক, চিঠিপত্রে। Captive Ladie নিজে ‘দৃষ্টান্ত’ হয়ে থাকে—বাঙালি কবি ইংরেজিতে মহাকাব্যিক রচনায় সক্ষম (Das 1982)।
Rajmohan’s Wife সমসাময়িকভাবে সীমিত পাঠক পেয়েছিল; ধারাবাহিক প্রকাশ, ইংরেজি ভাষা ও বাজার-অর্থনীতির সীমার কারণে। কিন্তু আজ এটি Indian Writing in English-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘উৎস-লেখা’—প্রথম ভারতীয় ইংরেজি উপন্যাসের বংশলতিকা টানতে গেলে এর নাম এড়ানো যায় না (Mukherjee 2000)।
উপনিবেশ-উত্তর পাঠে Captive Ladie এক “কাউন্টার-এপিক” সাম্রাজ্যিবাদের ভাষায় দেশীয় ইতিহাসের পৌরাণিক রচনা। এটি Mimicry বা Appropriation—উভয়ের সীমানায় দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে Rajmohan’s Wife—দেশীয় জীবনের নীরব ‘সাবঅল্টার্ন’ রুটিনকে ইংরেজি আখ্যানের কাঠামোয় সম্পৃক্ত করে —যেখানে “হাউসহোল্ড” আসলে ‘মাইক্রো-কলোনি’: বিধি, শাস্তি, নজরদারি (Foucaultীয় পাঠে) কাজ করে। এভাবে দুটো টেক্সট-ই ‘ইউরোপীয় ফর্ম’–কে দেশীয় উপাদানে ভরিয়ে তাঁদের নিজস্ব আধুনিকতা রচনা করে (Chaudhuri 2002; Mukherjee 2000)।
মাইকেল মধুসূদন ইংরেজি কাব্যে আত্মপ্রত্যয় দেখিয়েও খুবই দ্রুত বুঝলেন, বাংলায় লিখলেই নান্দনিক নাভিমূলে পৌঁছতে পারবেন। মেঘনাদবধ কাব্য ইউরোপীয় মহাকাব্য-প্রযুক্তির দেশীয় ভাষায় সাফল্যময় ট্রান্সক্রিয়েশন; সম্ভবত Captive Ladie-র ‘শিক্ষা’ ছাড়া এটি ভাবা যেত না। অন্যদিকে বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর Rajmohan’s Wife দেখলেন, বিদেশি ভাষায় দেশীয় সমাজের পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য আনতে গেলে টোনালিটি হারিয়ে যায়। তাই তাঁর বাংলায় প্রত্যাবর্তন স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয় যা ‘সহজাত উচ্চারণ’-এর সন্ধান ছাড়া আর কি হতে পারে ?
মাইকেল মধুসূদনের অলঙ্কার-প্রীতি কখনো কৃত্রিম; বঙ্কিমের ইংরেজি বাক্য-প্রকরণ কোথাও সাদামাটা। তবে ঐতিহাসিক দিক দিয়ে আলোচ্য লেখাদুটিই ‘প্রথম’-এর দায় বহন করে—Indian Writing in English-এর দুই ধারায় (কাব্য ও উপন্যাস) বাঙালির প্রাথমিক পদচারণা। আবার এই দুটিই নিজ নিজ ভাষায় (বাংলায়) বৃহত্তর কাজের “ট্রায়াল গ্রাউন্ড”—যা পরবর্তী শিল্পজীবনে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে ।
মধুসূদনের The Captive Ladie–তে এক জায়গায় নায়িকার বন্দিত্বকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, “The fair Princess, however, was retaken and sent to a solitary castle to be out of the way of her pugnacious lover.” তা যেন মধ্যযুগীয় রোমান্সকাহিনির ছায়া যেমন আছে, তেমনই ফুটে উঠেছে নারীর স্বাধীন ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাক-ঔপনিবেশিক–রাজশক্তির প্রতীক। একই সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র Rajmohan’s Wife–এ লিখছেন,“Matangini, though submissive in appearance, bore a tempest within.”
এই দুই উদ্ধৃতি নারীর চরিত্রচিত্রণে স্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করে—মধুসূদনের রোমান্টিক বন্দিনী কেবল পুরুষকেন্দ্রিক সংঘাতের প্রতীক, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মাতঙ্গিনী নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব, প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার এক আধুনিক রূপক।
অন্যদিকে আন্তঃপাঠ বা ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি বিচার করলে আমরা দেখতে পাই The Captive Ladie–র মূলকাহিনি মহাভারতের বংশধারা, রাজসূয় যজ্ঞ, এবং মধ্যযুগীয় প্রেম–অপহরণের কাহিনির সঙ্গে মিশ্রিত। মধুসূদন ইউরোপীয় রোমান্টিক কাব্যের ছাঁচে ভারতীয় উপাদানকে বসিয়েছিলেন ফলে এটি একই সঙ্গে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ। অন্যদিকে, Rajmohan’s Wife–এ ইউরোপীয় বাস্তবতাবাদী উপন্যাসের কাঠামো, ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক রূপান্তর, এবং ভারতীয় গৃহস্থজীবনের অন্দরমহল একত্রে যুক্ত হয়েছে। ফলে আমরা দেখতে পাই, মধুসূদনের রচনা ইতিহাস–পুরাণ–রোমান্সের সঙ্গে সংলাপ তৈরি করে, আর বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা উপনিবেশিক আইনি কাঠামো, বাংলার সমাজবাস্তবতা ও ইংরেজি সাহিত্যধারার সঙ্গে সংলাপে প্রবেশ করে। অন্যদিকে দুই গ্রন্থের প্রধান থিম হলো বন্দিত্ব বনাম মুক্তি। The Captive Ladie–তে বন্দিত্ব শারীরিক (দুর্গে বন্দিনী রাজকন্যা), মুক্তি প্রেমিক পুরুষের বীরত্বের মাধ্যমে। নারী এখানে প্যাসিভ চরিত্র কিন্তু Rajmohan’s Wife–এ মাতঙ্গিনীর মুক্তি মানসিক, সে নিজের দাম্পত্য, নৈতিকতা ও ভালোবাসার জটিলতার মধ্যে প্রশ্ন তোলে। এখানে নারী চরিত্রটি নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বকে বহন করে, যা পরবর্তী নারীমুক্তি আলোচনার এক পূর্বসূত্র। এছাড়া ভাষাশৈলীতেও পার্থক্য লক্ষণীয়। মধুসূদন ইংরেজি রোমান্টিক কাব্যের উজ্জ্বল উপমা, ছন্দ, এবং ক্লাসিক মহাকাব্যিক ভঙ্গি ব্যবহার করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র প্রয়োগ করেছেন গদ্যভাষার সংযমী বাস্তবতা, সামাজিক দৃশ্যপট ও সংলাপমুখর কাহিনিরীতি। সবশেষে, আধুনিকতার সন্ধানেও ও ভিন্নতা আছে। মধুসূদন চেয়েছিলেন ভারতীয় কাব্যকে বিশ্বসাহিত্যের স্তরে উন্নীত করতে ,তাঁর লক্ষ্য ছিল মহাকাব্যের ব্যপকতা । বঙ্কিমচন্দ্র চেয়েছিলেন বাংলা উপন্যাসকে সমাজের দর্পণ বানাতে—তাঁর লক্ষ্য ছিল বাস্তবতাবাদী আখ্যানের ভিত গড়া ।
সুতরাং The Captive Ladie এবং Rajmohan’s Wife—দুটি ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ফর্ম, ভিন্ন নন্দন; তবু একটি মিলিত গল্প বলে। গল্পটি হলো—কীভাবে বাঙালি লেখক ঔপনিবেশিক শিক্ষায় অর্জিত ইংরেজি ‘ক্যাননের’ মানদণ্ডে নিজেকে যাচাই করে, তারপর মাতৃভাষার ভিতরেই নিজের মৌলিক কণ্ঠ খুঁজে পায়। মধুসূদন ইউরোপীয় মহাকাব্যিকতা দেশীয় রসায়নে দ্রবীভূত করে বাংলা কবিতায় শিখর ছোঁয়; বঙ্কিম ইংরেজি গদ্যে প্রাথমিক অনুশীলনের পর বাংলায় উপন্যাসকে এমন এক পরিণত রূপ দেন, যা দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক কথাসাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্তর।
দুটি গ্রন্থ তাই শুধুমাত্র দুটি পুস্তক নয় বরং তা যেন ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ‘মডেল-রুম’। একটিতে ‘নেশন’-এর রোমান্স, অন্যটিতে ‘হোম’-এর নৈতিকতা। একটি “উচ্চারণ”, অন্যটি “কথা”—এবং দুটিই আমাদের শেখায়, ভাষা যেমন ক্ষমতার, তেমনই মুক্তির—সঠিক ভাষায় ফিরে আসা মানে নিজের ইতিহাসে ন্যায্য জায়গা ফিরে পাওয়া।
তথ্যসূত্র :
প্রাথমিক পাঠ
- Datta, Michael Madhusudan. The Captive Ladie. Calcutta, 1849.
- Chatterjee, Bankimchandra. Rajmohan’s Wife. Serialized in Indian Field, 1864.
সমালোচনামূলক পাঠ
- Chaudhuri, Rosinka. Gentlemen Poets in Colonial Bengal: Emergent Literatures and the Making of a Nation. Calcutta: Seagull Books, 2002.
- Das, Sisir Kumar. History of Indian Literature: 1800–1910. New Delhi: Sahitya Akademi, 1991.
- Das, Sisir Kumar. Michael Madhusudan Dutt: The Poet and the Playwright. New Delhi: Sahitya Akademi, 1982.
- Mukherjee, Meenakshi. The Perishable Empire: Essays on Indian Writing in English. New Delhi: Oxford University Press, 2000.
- Sen, Amiya P. Bankimchandra Chattopadhyay: An Intellectual Biography. New Delhi: Permanent Black, 2011.
- Viswanathan, Gauri. Masks of Conquest: Literary Study and British Rule in India. New York: Columbia University Press, 1989.
- Murshid, Ghulam. Ashar Chhaya Michael Madhusudan (Bangla); ইংরেজি ব্যাখ্যাসহ জীবনীমূলক রচনা—মধুসূদনের জীবন-মানস বুঝতে সহায়ক।
- Chaudhuri, Sukanta (ed.). Calcutta: The Living City (relevant essays on colonial Calcutta’s print and literary culture), Oxford University Press, 1995.
- Dev, Amiya (ed.). The Literary Criterion: Bankimchandra and His Writings. Mysore, 1977.


