বন্দনা সেনগুপ্ত
বাজারের ব্যাগটা হতে নিয়ে হনহন করে হাঁটছিল নমিতা। মাথার উপর চড়া রোদে ও বেশ ঘামছিল। জলখাবার তো খায়ই নি আজ, বেরোবার সময় নমিতা জল খেয়েও বেরোতে ভুলে গেছে।
সত্যি কি এখন বাজার করার দরকার ছিল! নমিতা জানে এখন বাজার আসার ততটাও দরকার ছিল না। যদিও বেরোবার সময় পাশের বাড়ির জেঠিমার প্রশ্নের উত্তরে ও মাছ কিনতে হবে বলেছে।
আসলে কাল থেকে রাগে ওর গা চিড়বিড় করছে। ঘরে টিকতে না পেরে অজুহাত খুঁজে বেরিয়ে এসেছে।
শ্যামল, ওর বর, স্বভাবে ভীষন চুপচাপ, গম্ভীর। প্রায় চোদ্দ বছর হল ওদের বিয়ে হয়েছে। ও জানে শ্যামল একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে হিসাব দেখাশুনার কাজ করে। কিন্তু, কত মাইনে পায়, কি বৃত্তান্ত, কিছুই জানে না। সাহস করে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, অভিমানী নমিতা ধমক খেয়ে সেই যে চুপ করেছে, আর কখনও কোনো প্রশ্ন করে নি।
শ্যামল প্রয়োজনের বাইরে কোনও খরচ করা পছন্দ করে না। রোজ বাজার করতে ওর অসুবিধা হয়, তাই একটা ফ্রিজ আছে। নিজে খেলা দেখতে খুব ভালবাসে, ওটাই শ্যামলের একমাত্র বিনোদন। তাই একটা টিভি আছে। আর, করোনার পর ছেলের পড়াশুনার জন্য বাধ্য হয়ে একটা স্মার্ট ফোন কিনতে হয়েছে। ব্যস্! ওদের বাড়িতে আর কোনো দামী জিনিস নেই। সে কাউকে কোনও উপহার দেওয়া পছন্দ করে না। ভাই বোনদের সবার চোখে ছোট হতে হতে নমিতা বাপের বাড়ি যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। অন্য অনুষ্ঠান বাড়িও যথা সম্ভব বাদ দেওয়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু, কালকের কথা ছিল আলাদা। শ্যামলের অফিসের একজনের বাচ্চার জন্মদিন। শ্যামল যা টাকা দিয়েছিল, তাতে খুব ভাল উপহার হয় না দেখে, নমিতা খামে ভরে টাকাটাই দিয়েছিল। নাম না লিখেই দিয়েছিল, যাতে কেউ ধরতে না পারে। কখন যে ওরা খুলে কত দিয়েছে, সেটা দেখে নিয়েছে নমিতা বুঝতে পারে নি। খাবার সময় কি সুন্দর করে ওরা নাম না করে হাসছিল। বলছিল যে কিছু কিছু পাবলিক কেমন খেতে আসে! ভাল কিছু উপহার দেওয়া দূরস্থান, সবাই মিলে খেলে যে খরচ হয়, সেটাও দেয় না। হি হি করে হাসছিল। আর, ওদের ভাল করে খাবার জন্য বিশেষ করে বলছিল। শ্যামল এবং ওদের ছেলে সান কিচ্ছু বোঝে নি। সুখাদ্য দেখে বার বার নিয়ে খেয়েছে। আর, নমিতা মরমে মরে গেছে। ও কিছু খেতেও পারে নি। ও যে সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পারছিল!
নমিতার রাগ আজও পড়ে নি। ওর অসহায়, অসহ্য লাগছিল তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু, মনের এরকম অবস্থায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে, খেয়াল নেই। হর্নের তীব্র শব্দে খেয়াল হলেও নিজেকে সামলাতে পারল না। জোরে ব্রেক কষার পরেও সাদা একটা চার চাকা ওকে ধাক্কা মেরেই দিল।
মাথায় চোট পেয়ে কত দিন হাসপাতালে ছিল, কবে বাড়ি এল, কিছুই খেয়াল নেই। ভাল করে যেদিন জ্ঞান এলো, দেখল শ্যামল সকালের চা নিয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে উঠিয়ে বসিয়ে চা খাওয়াল। কখন রান্না করেছে বুঝতে না দিলেও জল খাবার খাওয়ালো। ছেলেকে স্কুলে পাঠালো। এবার নিজে তৈরী হয়ে অফিস যাবে। তার আগে সারা দিন থাকার জন্য আয়া মাসী এলো। শ্যামল না ফেরা অবধি সে থাকবে।
কি রোগা হয়ে গেছে শ্যামল! কণ্ঠার হাড় যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। জামা কাপড় সব ঢিলা হয়ে গেছে। নমিতা ভেবে পায় না এত খরচই বা শ্যামল কি করে করছে! কদিন বাদে একটু উঠতে পারলে ঘুরে ঘুরে দেখে। দেওয়াল খালি, টিভি নেই। রান্নাঘর খালি, ফ্রিজ নেই। একদিন আয়া মাসী আসে নি। যা কোনদিন করে নি, নমিতা সেদিন তাই করল। শ্যামলের আলমারি খুলল। লকার খুলে পাসবুক বার করে দেখল তাদের কিছু টাকা, এফডি ছিল। কিপটে শ্যামল যা কিছু সঞ্চয় করেছিল, বিনা প্রশ্নে তার চিকিৎসায় খরচ করে দিয়েছে।
আজ নমিতার চোখে দুঃখ, ক্ষোভ বা অভিমানের নয়, প্রেম ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতার জল।


