সৌভিক ঘোষাল
ভারতীয় নাট্যধারার বহুমাত্রিক ঐতিহ্যের মধ্যে মণিপুর এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পাহাড়ে ঘেরা এই রাজ্যে লোকজ সংস্কৃতি, নৃত্য, সঙ্গীত, আচার ও বিশ্বাস নাট্যকলা সঙ্গে মিশে গড়ে তুলেছে অনন্য নাট্যঐতিহ্য। মণিপুরের নাট্যশিল্পের মূল ভরকেন্দ্র হলো বৈষ্ণব ধর্মীয় রীতি, লোকনৃত্য এবং সংগীতের নিবিড় সংমিশ্রণ। রাসলীলার আধ্যাত্মিক মহিমা, লাই-হারাওবা-র সৃষ্টিতত্ত্ব, শুমাং লীলা-র খোলা আকাশের অঙ্গনভিত্তিক নাট্যরূপ, কিংবা থাংতা-র যুদ্ধকৌশলভিত্তিক নৃত্য—সব মিলিয়ে মণিপুরী নাট্য ঐতিহ্য এক অনন্য রূপকল্প সৃষ্টি করেছে।
এই ধারারই আধুনিক রূপকার ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যব্যক্তিত্ব হলেন রতন থিয়াম। ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি ইম্ফলে জন্ম নেওয়া রতন থিয়ামের জীবনশৈলী ও নাট্যচিন্তা ভারতীয় আধুনিক নাটকের ভুবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় ইব্রাহিম আলকাজির তত্ত্বাবধানে পাশ্চাত্য নাট্যকলা শিক্ষা নেওয়ার পর তিনি মণিপুরে ফিরে এসে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কোরাস রিপার্টরি থিয়েটার। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর নাট্যযাত্রার এক নতুন অধ্যায়।
রতন থিয়ামের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে উরুভঙ্গম, চক্রব্যূহ, উত্তর প্রিয়দর্শিনী, ম্যাকবেথ, অন্ধযুগ, নাইন হিলস্ নাইন ভ্যালিস্ ইত্যাদি। বিশেষ করে চক্রব্যূহ ও উত্তর প্রিয়দর্শিনী আধুনিক ভারতীয় নাট্যভুবনে ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। তাঁর নাটকে কেবল সংলাপ নয়, বরং আলোক-ধ্বনি, কোরিওগ্রাফি, সংগীত, লোকনৃত্য, মার্শাল আর্ট ও দৃশ্যাবলীর সমন্বয়ে দর্শকের কাছে এক গভীর নান্দনিক ও দর্শনমূলক অভিজ্ঞতা পৌঁছে গেছে।
থিয়ামের নাট্যচিন্তায় মণিপুরী লোকঐতিহ্যের প্রভাব গভীর। রাসনৃত্য, থাংতা, পেনা, ওয়ারি-লিবা প্রভৃতি উপাদান তিনি ব্যবহার করেছেন যুদ্ধ, হিংসা, সামাজিক বৈষম্য ও মানবিক সংকটের মতো আধুনিক সার্বজনীন বিষয় মঞ্চস্থ করার জন্য। তাঁর থিয়েটার অফ রুটস আন্দোলন ভারতীয় নাটককে উপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত করে দেশীয় শিকড়ে ফিরিয়ে আনার এক সাহসী উদ্যোগ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
রতন থিয়াম কেবল নাট্যকার বা পরিচালক নন, তিনি ছিলেন সামাজিক প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরও। মনিপুরের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদ্রোহ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি নাটককে ব্যবহার করেছিলেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। এজন্যই তিনি পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
২০২৫ সালের ২৩ জুলাই, ৭৭ বছর বয়সে রতন থিয়ামের প্রয়াণে ভারতীয় নাট্যভুবনে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। তবুও তাঁর সৃষ্ট নাট্যজগৎ, কোরাস থিয়েটারের অভিজ্ঞতা এবং শিকড়ের অন্বেষণ আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
মণিপুরী নাট্য ঐতিহ্য ও রতন থিয়ামের অবদান তাই এক অখণ্ড সূত্রে বাঁধা—যেখানে স্থানীয় লোকজ ঐতিহ্য ও আধুনিক সার্বজনীন ভাবনা মিলিত হয়ে বিশ্বনাট্যের ভুবনে এক অমোঘ ছাপ রেখে গেছে।


