সঞ্জীব কুমার সাহা
গল্পটা রাজবিহারের।
রাজবিহার জেলায় এগারোটা ব্লকের অন্যতম হল চুয়াডাঙ্গা উন্নয়ন ব্লক। কাছেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত। তো এই চুয়াডাঙ্গা ব্লকের অফিসে মোসলেম মিয়া নামে একজন আজ্ঞাবাহী অর্ডারলি পিওন আছেন। এই জমানাতেও পঞ্চাশ পেরোনো মোসলেম মিঞা দুর্লভ ভাবেই সৎ ও নির্লোভ এবং অবশ্যই গোবেচারা প্রকৃতির মানুষ হয়েই থেকে গেছেন। তিনি প্রতিদিন নিয়ম মাফিক সময় মতন অফিসে আসেন এবং বিডিও সাহেবের চেম্বারের বাইরে একটা পুরানো চেয়ারে চুপচাপ বসে কান খাড়া করে থাকেন। মাঝে মাঝে গুয়াপান চিবিয়ে খান। মুখ লাল করেন। যাই হোক তিনি সব সময় ভাবেন এই বুঝি সাহেব তাঁকে ডাকেন। টয়লেটে গিয়েও শান্তি পান না। অন্য কেউ কিছু কাজ করতে বললেই বলে, “না জাং, মুই না পারিম।” মানে যাবো না, আমি পারিনা। কিন্তু বিডিও সাহেব কলিং বেল টিপলেই তিনি শশব্যস্ত হয়ে এই বয়সেও লাফিয়ে উঠে সেই আড্ডা পালনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর এই আড্ডা পালন করতে গিয়েই মোসলেম মিঞা ঘটান নানান বিপত্তি, নানান হাস্যকর ঘটনা।
এখানে তেমন কয়েকটি নির্মল মজার ঘটনার কথাই বলব। অন্যভাবে নেবেন না প্লিজ। যাইহোক গল্পে ফিরি। যা বলছিলাম, বিডিও সাহেব হয়ত জরুরি দরকারে তাঁকে ডেকে আনতে বললেন নারেগার এপিও (A.P.O) অর্থাৎ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম অফিসার সাহেবকে, আর তিনি দুটো বিল্ডিং টপকে ডেকে আনলেন মৎস দপ্তরের একইও (F.E.O.) অর্থাৎ ফিশারি এক্সটেনশন অফিসার সাহেবকে। এমনটা না হয় সামান্য উচ্চারণের পার্থক্যে ভুল হতেই পারে। কিন্তু হয়রানি বাড়ে দুজনেরই। গভীরভাবে চার জনের হয়রানি। তাই আজকাল বিডিও সাহেব নতুন কোড নেম চালু করেছেন। বলেন ‘মাটিকাটা এপিও’ এবং ‘মেছো একইও’। এই টোটকায় কাজ দিয়েছে অবশ্য কিন্তু ‘মাটিকাটা এপিও’ এবং ‘মেছো একইও’ শুনে সেই সময়ে
চেম্বারে থাকা লোকেদের মজা ও কৌতূহল দুইই হয়। বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমার শোনা কথা, মোসলেম মিঞা মাত্র কিছুদিন আগে এই অফিসের গ্রুপ-জির চাকরিতে ঢুকেছেনা। মাপকাঠি বা স্কেল কি জিনিস তা তিনি জানতেন না তখন। তিনি জানতেন ইসকেল। তাই বিডিও সাহেব স্কেল আনতে বলায়, তিনি বড় বাবুর কাছে গিয়ে হাত দিয়ে আকারে ইলিতে স্কেলের কথা বুঝিয়ে বলেন, “ওই যে লম্বা মত। এলাং দাগ দাগ। পিঠ চুলকাইলে ঘৰতে লাগে। হাগলে মুখ বাড়াইলে মারণ লাগে, সাহেব হেইখান চাইসেন।”
বোজো কান্ড! একথা শুনে বড়বাবু বিপুলবাবু ভিরমি খান আর কি। কি মহার্ঘ বন্ধ্য সাহেব চাইছেন তিনি বুঝতে পারেন না। নিজেই সাহেবের কাছে গিয়ে বুঝলেন স্কেল লাগবে। ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন থেকে একটা নয়, গোটা তিনেক স্কেল আর দুখানি ফিতে তিনি বিডিও সাহেবকে দিয়ে গেলেন। জানিনা সাহেবের কখন আবার দরকার
পরে।
বছর খানেক আগের কথা। মোসলেম মিঞা সাইকেল চেপে সবজিহাটি থেকে দুই হালি কলা আর আধা কিলা গুড় কিনে বাড়ি ফিরছেন। ফেরার পথে মোসলেন মিঞাকে একজন পথচলতি বাইক চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন এবং নিজেও পড়লেন। এতে মোসলেন মিঞা হাতে ও পায়ে অল্পবিস্তর চোট পেয়েছিলেন এবং তার সাইকেলেরও সামান্য কিছু ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু তিনি নিজের সাইকেল হেড়ে সবার আগে বাইক চালককে বাইকের নিচ থেকে উদ্ধার করলেন। আশেপাশের দোকানদার মোসলেনের পক্ষ নিয়ে বেশ কিছু টাকা আদায় করতে চাইলেন। কিন্তু তাঁর এক গোঁ, “কাস্তেম্বরবাবু কি ইচ্ছে করে তাঁকে বাক্কা নারসে? বেরেক ফেল কইরা নারসে। ওনারে হাইড়্যা দ্যান।” তারপক্ষের লোকেরা হাল ছেড়ে দিল।
মোটর আরোহী কান্তেশ্বর বসুনিয়া খুশি হয়ে সাইকেলের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড়- দুই হাজার টাকা দিতে চাইলেন। সাদাসিধে মোসলেন মিঞা সাইকেল মেরামতির খরচ বাবদ দোকানদার যা চাইলেন তার বেশি পাঁচ পয়সাও চাইলেন না। লোকসানের মধ্যে তাঁর একহালি কলা আর ওই পাঁচশো গ্রাম আঁখের গুড়। সেটা তাঁর হিসেবে ধরলেন না। তিনি মাত্র ৩০০ টাকা ওই বাইক চালক ভদ্রলোকের থেকে নিয়েছিলেন। ঘটনার তিন সপ্তাহ পরে।
মাস হয়েক আগে মোসলেন নিঞা বুঝে বা না বুঝে এমন একটা সরস কাণ্ড ঘটালেন, যে গুরুগম্ভীর বিডিও সাহেবও হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। বিডিও সাহেব ডেকে আনতে বলেছিলেন ইএমওইই বা মাস এডুকেশন অফিসার ঝাঁ সাহেবকে। তিনি মৈথিলি ব্রাহ্মণ। তিনি সেই সময় নিজের সিটে ছিলেন না। মোসলেন মিঞা ওই অফিসারের পাশের চেয়ারের কর্মচারীকে না দেখতে পেয়ে বিডিও সাহেবকে এসে বলেন ‘স্যার, আজকে শুক্রবার, উনি তো নামাজ পড়তে গেছেন।’ তখন বিডিও সাহেব হাসতে-হাসতে বললেন ‘ব্রাহ্মণ মানুষ নামাজ পড়তে গেছেন,এটা তো জীবনে প্রথম বার শুনলাম।’
দিন গনের আগে, মোসলেম মিঞা ঘটালেন আরও একটা মজাদার কাণ্ড। বিডিও সাহেব তাকে দুই হালি (৮টা) দেশি মুরগির ডিম আনতে টাকা দিয়েছিলেন। মোসলেন মিঞাও যথারীতি ২ হালি দেশি মুরগির ডিম কিনে এনে বাকি টাকা বিডিও সাহেবকে ফেরত দিতে গেলেন। ডিমের দাম জিজ্ঞেস করায় মোসলেম মিঞা জানালেন সোন্নাত্তর টাকা। এই সোয়াত্তর শব্দের অর্থ বিডিও সাহেবের বোধগম্য না হওয়ার, তিনি বড়বাবুকে ডাকলেন। ডেকে বুঝতে পারলেন ২ হালি দেশি মুরগির ডিমের দাম হয়েহে সত্তর টাকা।
মোসলেম মিঞা এইভাবে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু ভুলচুক করেন, তবে বিডিও সাহেব তার উপর খুব একটা বিরক্ত বা রুষ্ট হন না। মোসলেম মিঞার সততা ও নিয়মানুবর্তিতার জন্যই, একজন বয়স্ক কর্মচারী হিসাবে বিডিও সাহেবও তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির চোখেই দেখেন। অফিস ক্যাম্পাসে কখনও স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন হলে মোসলেম মিঞার মতন সামান্য অর্ডারলি পিওনই সর্বপ্রথম সাহস করে এগিয়ে এসে জোর গলায় বলেন ‘স্যার, আমি রক্ত দিব।’
সত্যি, মোসলেন মিঞার মতন সৎ, সহজ-সরল মানসিকতার কর্মচারীরা আছেন বলেই তো সরকারি অফিসগুলোতে সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতির সুপারিবেশটা এখনো বজায় আছে।