শারদ আলাপ ১৪৩১

আবার রোদ্দুর !
প্রস্তুতি ছিলই। মাঝে তাল কাটছিল। শেষমেশ সামলে নেওয়া গেল। আসলে যে সয় সে রয় – থেকে যায়। রোদ্দুর তাই ফিরে ফিরে আসে। রোদ্দুরের আদি ঘোড়াদের অধিকাংশই এখন এই মহানগরে থাকে না, থাকেন না। তবুও তাদের ভাবনায় বার বার ফিরে আসে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরি ও ভাষা শিক্ষালয় সংলগ্ন বুলেভার্ডের আড্ডা এবং সেখান থেকে থেকে জন্ম নেওয়া এই রোদ্দুর পত্রিকার কথা। ঠিক যেমন মেঘলা দিন , কুয়াশাঘন রাত -ভোর কাটিয়ে ঝলমলিয়ে রোদ্দুর আসে। যে কিশোর কিশোরী এই রাজ্য কিংবা ভিন রাজ্যের দূর ইস্পাত নগরী বা টাউনশিপ থেকে এসেছিল , এই মহানগরের মহাস্রোতে দু-দন্ড দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছিল , মেঘ রোদ্দুরে , যে শিল্পীরা উঠে এসেছিল আর্ট কলেজের অলিন্দ থেকে যে যুবক যুবতিরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিজ্ঞাপন সংস্থার অফিস কিংবা কাছারি থেকে এসেছিল চায়ের আড্ডায় কিংবা রবীন্দ্রসরোবরে বসেছিল। আজ তারা মধ্য চল্লিশে কিংবা পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই । মাঝ গগনে সূর্য। রোদ্দুর ও তাই। আসলে রোদ্দুর এক প্রতিশ্রুতি – অপার বন্ধুত্বের , সাহিত্যের এবং স-হিতের। হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। নতুন প্রজন্মের দিকে ,পুরানো প্রজন্মের দিকে। সমকালের দিকেও।
হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই। আমরা ক’জন একটা ‘এ-ফোর’ পাতার দুপিঠে ছয় টুকরো আকাশ নিয়ে একটা ফোল্ডার তৈরি করে রোদ্দুর পত্রিকার যাত্রা শুরু করেছিলাম মাত্র। আমরা নিজেদের রোদ্দুরের ঘোড়া বলতাম। ভালবেসে মন্দাক্রান্তা সেন সেই সময়েও কবিতা দিয়েছিলেন। এবারেও তিনি ফেরান নি। এখন এই বিপুল কলেবর রোদ্দুরের- পরিসরও বিশ্বজুড়ে । যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি আমরা। আসলে রোদ্দুর মানে ছুঁয়ে থাকার চেষ্টা। নামী ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক কবি সাহিত্যিক সম্পাদক উদ্যোগপতি সমাজকর্মী নাট্যকর্মী আমলা থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠক পাঠিকা কাদের না সহযোগিতা পেয়েছি আমরা। কৃতজ্ঞতা জানবার ভাষা নেই।
প্রতিবার নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে রোদ্দুর ফিরে আসে । মন ভালো করে দিয়ে যায় এক চিলতে রোদ্দুর । আমাদের রোদ্দুর পত্রিকাও যেন ঠিক তেমনি নতুন নতুন শারদ সাহিত্য উপহার নিয়ে আসে । এবার বাংলাদেশ থেকে এসেছে উপন্যাস, আবছায়া ,চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন রেদওয়ান খান। রেদওয়ান এই বাংলায় পরিচিত হতে শুরু করেছেন। অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যেও ‘কেউটে’ গল্প পাঠিয়েছেন রোখসানা ইয়াসমিন মণি। এছাড়াও বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য কবিতা,ছোটগল্প,অনুগল্প,আঞ্চলিক কবিতা ইত্যাদি পেয়েছি। সুদূর কেন্টাকি থেকে আরতি হালদার এই প্রথমবার লিখেছেন এই সময়ের ভাষ্য। কোটা আন্দোলনের শুরুর দিনে সে বরিশাল ও ঢাকায় ছিল। তারপর পড়াশুনোর জন্যে সে পাড়ি দেয় আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রে। সেখান থেকেই এই পত্রিকার জন্য যাত্রাপথের নিবন্ধ লিখেছে -দেশে দেশান্তরে। আমরা প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম , সাম্প্রতিক অসহিষ্ণু পরিস্থিতিতে সেদেশের লেখা ছাপবো কি না ! শেষে সিদ্ধান্ত হয় মানুষের কথা শোনা দরকার ,মানুষের কাছে পৌঁছনো দরকার। প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে অযথা দেয়াল তুলে দেওয়া ভালো কথা নয়। রোদ্দুর যেমন সব অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে এই পত্রিকাও তার সীমিত পরিসরে চেষ্টা করে যাবে। আমরাও চাই প্রতিবেশী ভাল থাকুন ,প্রতিবেশী দেশ ভালো থাকুক। তাই প্রতিবেশী দেশের শিল্প সাহিত্য ইত্যাদির জন্য জানালা খোলা রাখা জরুরি।
আমরা এবার ভারত দর্শন বিভাগে চেষ্টা করেছি প্রতিবেশী রাজ্যগুলির নমুনা সাহিত্যকে ছুঁয়ে দেখার। উত্তর পূর্ব ভারত যেন এক অনাস্বাদিত জগৎ। তার রূপ রং রসের ছোঁয়া তার সাহিত্যে। জীবন যন্ত্রণার কথাও। তাই উত্তর পূর্বের সাত রাজ্যের সাতজন মহিলা কবি ও সাহিত্যিকের সাতটি নমুনা কবিতা এবারের রোদ্দুরে। অসমের মামনি রাইসম গোস্বামী থেকে শুরু করে মণিপুরের মহারাজকুমারী বিনোদিনী দেবী, মেঘালয়ের নবীনা কবি নবনীতা কানুনগো, মিজোরামের জোহমিংলিয়ানি , নরওয়েবাসী নাগাল্যান্ডের কবি ও উপন্যাসিক ইস্টারিন কিরের পাশাপাশি পড়শি রাজ্য সিকিমের নবীনতমা কবি সুরক্ষা তামাং-এবং ত্রিপুরার প্রবাদ প্রতীম অনঙ্গমোহিনী দেবীর কবিতা থাকছে এই শারদ সংকলনে।
ইচ্ছাছিল ভারত দর্শন বিভাগে সংবিধান স্বীকৃত সবগুলি ভাষার সাহিত্যের নমুনা রোদ্দুরের এই সংখ্যায় রাখব কিন্তু স্থান ও সময়ের অভাবে সবগুলি রাখা সম্ভব হলনা। আশা রাখুন সামনের বছর অবশ্যই থাকবে । এসবের মধ্যেই রাখতে পেরেছি অহমিয়া কবিতা ,বোড়ো কবিতা,হিন্দি গল্প ,কাশ্মিরী কবিতা ,কোঙ্কনি কবিতা ,মৈথিলী কবিতা , চন্দ ঝাঁ,মালায়লাম কবিতা,মারাঠি কবিতা,নেপালি কবিতা ও সাঁওতালি কবিতার কিছু মূল কবিতা ও তার অনুবাদ। আসলে অনুবাদ কবিতা যেন আমাদের দিগন্ত প্রসারিত করে। সব সাহিত্যই যেন তাই।
ভুবনগ্রাম বিভাগে এবার আমরা তুলে এনেছি প্রখ্যাত ফিলিপ কে. ডিক-এর মার্কিন কল্পবিজ্ঞান কাহিনী। সৌরভকুমার ভূঞ্যা মুন্সিয়ানার সাথে গল্পটির ভাষান্তর ঘটিয়েছেন। ঠিক যেমন প্যালেস্টাইনের কবিতা এনেছেন জ্যোতি ঘোষ। তাঁর অনুবাদে মাহমুদ দারভিশের একটি কবিতা ‘আমরা একটা দেশের দিকে হেঁটে যাচ্ছি ‘ রোদ্দুরের এই সংখ্যায়। আমরা ইজরিয়েলি কণ্ঠ শোনার পাশাপাশি প্যালেস্টাইনের কথাও শুনব। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্য সম্পর্কে তিন তিনটি নিবন্ধ লিখেছেন পেশায় অ্যাডভোকেট কিন্তু নেশায় সাহিত্যিক তন্ময় কবিরাজ। তাঁর লেখা ‘ভুটান ভায়া কুনজং’,’ইরানের কবি ওমর খৈয়ামের সুখ’ ও ‘আডোনিস : সিরিয়ার কবিতা’ সন্ধানী পাঠকের ক্ষুধা বৃদ্ধি করবে আশা করা যায়। এই ভুবনগ্রাম বিভাগেই নবকুমার দাস বিশ্বজুড়ে অতিমারীর সময়ে বা পরবর্তীকালে সেই সময়ের বা সেই বিষয়ে যে সাহিত্য ও স্মৃতিকথা ইত্যাদি লেখা হয়েছে তাই নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ ‘কোভিড-পরবর্তী বিশ্ব-সাহিত্য : একটি অন্বেষণ’ লিখেছেন। তাঁর এই লেখায় উঠে এসেছে করোনোকালের সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যের মণিমুক্তা। পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই তার রসাস্বাদন করবেন।
অনুবাদ পত্রিকার ব্যস্ত সম্পাদিকা বিতস্তা ঘোষাল খুব কম সময়ের মধ্যেও রোদ্দুরের জন্য লিখেছেন একটি বড় গল্প। উত্তমকুমার পুরকাইত এবং রতনকুমার ভট্টাচার্য তাঁদের শত ব্যস্ততা এবং অন্যরকম পেশার জগতের মানুষ হয়েও যে রকম ভাবে রোদ্দুরের জন্য বড় গল্প লিখেছেন তার জন্যে প্ৰশংসনীয়। একই রকমভাবে আলাদা করে বলতে হয় রোদ্দুরের এবারের কুড়ি জন ছোটগল্প লেখক -লেখিকার কথা। বিশেষ ধন্যবাদ জানাবো পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌসুমী পাত্রকে যাঁরা আগে জমা করা লেখা অন্য পত্রিকায় সম্প্রতি ছাপা হয়েছে জেনেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানিয়েছেন ও রাতারাতি বিকল্প সমমানের লেখা জমা দিয়েছেন। তবে বিশেষ ধন্যবাদ জানাবো রোদ্দুরের সেই সব লেখক ও কবি সাহিত্যিকদের যাঁদের লেখা আমরা এবার পর্যাপ্ত পরিসর না থাকায় ছাপতে পারলাম না। তাঁদেরকে রোদ্দুরের অনলাইন প্রকাশনায় লেখার জন্য আহ্বান জানিয়ে রাখছি। তবে প্রাপ্তি হিসেবে জানিয়ে রাখি সুদীপ পাঠকের অলীক চোর একটি অসাধারন কাহিনী। একই রকমভাবে রোদ্দুরে এবারে প্রকাশিত গল্পগুলি সংগ্রহে রাখার মত হবে আশা করি। মৌসুমী পাত্রের মরীচিকা , অনির্বাণ চৌধুরীর ইচ্ছাপূরণ ইত্যাদি গল্প যেন মুগ্ধ করে রাখে। বিশেষ করে বলব সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে স্বপন জায়দারের সুন্দরম্ ও অর্দ্ধেন্দু মণ্ডলের পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিমতী উপকোশা গল্প দুটি। এছাড়া বিশেষ আকর্ষণ কুশল মৈত্রর মেঘ-রোদ্দুরের ধারাপাত গল্পটি। হোক কুড়িটি গল্প যেন রোদ্দুরের কুড়িটি বর্ণচ্ছটা। প্রান্তিক মানুষের কথা লিখেছেন আব্দুল বারী,সজল দেব লস্কর ও আশুতোষ দেবনাথ। রোদ্দুরের আঙিনা তাই সবার কথা বলে। নরনারীর সম্পর্কের জটিলতা ,ওঠাপড়া ,দেশভাগ ইত্যাদির কাহিনীও সমানভাবে ঠাঁই পেয়েছে এবারের গল্পের আসরে ,ছোটগল্পের মতই অণুগল্পগুলি বৈচিত্রময়।
আঞ্চলিক কবিতা নিয়ে পুরুলিয়ার সাগর মাহাত, রংপুরের রত্না রানীর কবিতা থাকছে। থাকছে রম্যরচনা ও ছড়া ছাড়াও ভ্রমণ কাহিনী। এবারের ভ্রমণ কাহিনীতে থাকছে ঋষিখোলা ও সিলারীগাঁও ভ্রমণের কাহিনী ঋষি নদীর তীরে। লিখেছেন সোহম চক্রবর্ত্তী।এছাড়া দক্ষিণের কাঞ্ছিপুরম কামাক্ষী মন্দির দর্শন নিয়ে লিখেছেন রাধারমন গাঙ্গুলী।
সম্প্রতি রোদ্দুর পরিবারের অন্যতম সহযোগী কৃতী বর্ণালী রায়কে আমরা হারিয়েছি। কর্কটরোগ কেড়ে নিল তাকে। তাঁর স্বামী দেবনাথ রায় রোদ্দুরের পাঠক পাঠিকা ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য তুলে দিয়েছে বর্ণালীর একটি শিল্পকর্ম সেটাই রোদ্দুরের পিছনের প্রচ্ছদ। রোদ্দুরের জন্য লেটারিং করেছেন শিল্পী শুভেন্দু সরকার, ছবি এঁকেছেন কৌস্তভ মাজি, ছবি তুলেছে অরুণাভ দাস। আরতি হালদার তার লেখার উপযুক্ত ছবি নিজেই তুলেছেন। পত্রিকার প্রচ্ছদ সজ্জায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে মোহাম্মদ হাবিব হাসান ও নবকুমার দাস।
পত্রিকার জন্য অতি ব্যাস্ততা ও শত সহস্র সমস্যা থাকা সত্ত্বেও যেভাবে সৌরভ মন্ডল ও শুভদীপ চক্রবর্তী দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন তাদের জন্য যে কোনো প্রশংসাই কম মনে হবে। বলতেই হয় নান্দনিক প্রকাশনীর কথা যাদের সহযোগিতা ভিন্ন বিপুল এই পত্রিকার প্রকাশ করা সম্ভব হতনা।
সবশেষে বলব ,দিবা রাত্রির কাব্য পত্রিকার সম্পাদক আফিফ ফুয়াদের কথা যার সক্রিয় সহযোগিতা ও পরামর্শে মহাবোধি সোসাইটির সভাগৃহে এই পত্রিকা প্রকাশিত হল। পত্রিকাটি প্রকাশ করলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক মাননীয় গৌতম ঘোষ মহাশয় । ওই অনুষ্ঠানে দিবা রাত্রির কাব্য পত্রিকার সম্পাদক আফিফ ফুয়াদ সহ উপস্থিত থাকলেন সুশোভন অধিকারী, অসীম চট্টোরাজ, চিত্রদীপ সেন প্রমুখ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
সম্পাদকমন্ডলী রোদ্দুরের ঘোড়াগুলি
কলকাতা
৫ই অক্টোবর , ২০২৪
১৮ই আশ্বিন ,১৮৩১
