আমার পড়া, আমার ভালোলাগা

আমার পড়া, আমার ভালোলাগা

♥ মধুসূদন চৌধুরী  

আমরা যারা নিয়মিত লেখালিখি করি না, কিন্তু একটু আধটু পড়তে ভালোবাসি আর ভালোবেসে পড়া চালিয়ে যেতে চাই অথচ পারি না, তাদের যদি হঠাৎ করে পড়া নিয়ে লিখতে বলা হয় তখন নিজেদেরকে খুব বিপদাপন্ন মনে হয়।

একটা গ্রন্থাগারের কাজ করার সুবাদে গ্রন্থাগারের যে সমস্ত নিয়মিত পাঠককে দেখি, তাঁদের সাথে তাঁদের পড়া নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি যে তাঁরা নিজেদের পড়া সম্পর্কে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। এই মুহূর্তে তাঁদের সঙ্গে নিজেকে একাসনে বসিয়ে তুলনা করতে গিয়ে মনে হচ্ছে যে, যে পড়া আমাকে ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করে অথবা করে না, পড়ার সময় তা বিশ্লেষণ করে কখনো লিখতে হবে এইটা মাথায় থাকে না। সেজন্যেই ভালোলাগার পড়া বা পড়ে ভালোলাগার অনুভূতি চট করে কলম দিয়ে নেমে আসতে চায় না। যাঁরা বইয়ের সমালোচক অথবা নিয়মিত লেখক, তাঁরা পড়ার সময় মাথায় রাখেন যে এটা নিয়ে তাঁদের লিখতে হবে, ফলে তাঁদের পড়ার ধরন হয়তো বদলে যায়।

আমরা যারা ওই গোত্রে পড়ি না, আমাদের তাই ভালোলাগার পড়া কোনো বই অথবা পড়ে ভালো লেগেছে এরকম কোনো বই আমাকে কতটা প্রভাবিত করেছে তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে এই মুহূর্তে মাত্র তিনটে বইয়ের কথা মাথায় আসছে।
একটি আব্দুল জব্বারের ‘বাংলার চালচিত্র’ দ্বিতীয়টি নারায়ণ সান্যালের ‘বকুলতলা পি এল ক্যাম্প’, এবং তৃতীয়টি শাহ্ যাদ ফিরদাউস এর লেখা ‘ব্যাস’।

আমার জন্ম কলকাতায়, বড় হয়ে ওঠা হুগলি জেলায়। তাই যখন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় গ্রন্থাগারিকের কাজে যুক্ত হতে চললাম, তখন আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন আব্দুল জব্বারের “বাংলার চালচিত্র” পড়ে নিতে। বাবার কথায় পড়েছিলাম, তবে ছেঁড়া ছেঁড়া সেই পড়ায় খুব মনোযোগ ছিল না, কারণ সেটা ছিল দরকারের পড়া। আমাকে যদি এখন ‘বাংলার চালচিত্রে’ কী আছে তা জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে কুড়ি বছর আগে পড়া একটা বইয়ের ভাবনা, শৈলী কোনটাই খুব গুছিয়ে বলতে পারব না, কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় সাধারণ গ্রন্থাগারে পড়তে আসা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জেলা বইমেলা করতে জেলার নানা প্রান্তে নানা মানুষের সঙ্গে কাজ করতে বা গাড়ি নিয়ে ভ্রাম্যমান পরিষেবায় হাটে-ঘাটে মানুষকে বই সরবরাহ করতে গিয়ে যখন ছোটখাটো নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে তখন কোনো সময়েই মানুষগুলোকে অচেনা মনে হয়নি। সবসময়ই মনে হতো এই মানুষগুলোকে আমি বোধহয় আগে থাকতেই চিনি, কোথাও তাদের দেখেছি।
সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে বড় হওয়া একজন মানুষ কাজের সূত্রে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে এসে সেই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় নিজে কোনো সময় অপ্রস্তুত হচ্ছেন না, একটা আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে কাজ করছে যে তিনি অচেনা পরিবেশে নেই সেই বোধ বা অনুভব একজন মধ্য তিরিশের মানুষের মধ্যে তৈরি করে দেওয়ার মতো এরকম শক্তিশালী বই বাংলা সাহিত্যে আমার আর একটাও পড়া নেই। এই অনুষঙ্গে যদি কেউ এরকম আরো বই পড়ার অভিজ্ঞতা কখনো জানান তাহলে সেটা একটা দারুন প্রাপ্তি হতে পারে।

উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, সেই সময় হাতে এলো ‘বকুলতলা পি এল ক্যাম্প’ বইটা।
ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে উদ্বাস্তু কলোনির দায়িত্বে নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নারায়ণ সান্যালের লেখা এই উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র একজন ইঞ্জিনিয়ার, ঋতব্রত। উদ্বাস্তু কলোনির একটি মেয়েকে নিয়ে তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের চরিত্র হননের চেষ্টার এক খন্ডচিত্রে একটি চরিত্রকে লেখক হাজির করলেন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার, সঞ্জীব চৌধুরী।
একটা আপাত সাধারণ পঙক্তি ছিল সেই চরিত্রের মুখে–” নাঃ? তুমি পারবে না। ও তোমার কর্ম নয়। তুমি শুধু আমার ভরসায় এগুচ্ছ —- নিজের জোরে নয়। এ কাজ তার পক্ষেই সম্ভব যে নিজের জোরে চলতে পারে।”
খুব সচেতন ভাবে বলতে পারি নিজের জোরে চলতে শেখার এই জীবনদর্শনটা তৈরি হয়েছিল একটি সাধারণ মানের জনপ্রিয় বাংলা উপন্যাসের এক কাল্পনিক চরিত্রের হাত ধরে, বাবা-মা বা কোনো শিক্ষকের হাত ধরে নয়। নিজের জোরে চলতে পারার এক কণা স্বীকৃতিও যদি জোটে তাহলে তার কৃতিত্ব সঞ্জীব চৌধুরীর ওরফে নারায়ণ সান্যাল ওরফে বকুলতলা পি এল ক্যাম্পের, আমার নয়।
বছর পাঁচেক আগে পড়া শাহ্ যাদ ফিরদাউসের লেখা ব্যাস উপন্যাসের একটা অনুচ্ছেদ উল্লেখ না করে পারছি না—-
“বৈশম্পায়ন একটু আগে হাঁটছিলেন। বেশ কিছুটা এগিয়ে তিনি ব্যাসদেবের জন্য দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরলেন এবং হঠাৎ প্রায় চিৎকার করে ডাকলেন —গুরুদেব!
ব্যাসদেব বিস্মিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে তাঁর চিৎকারের অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলেন —কি হয়েছে বৈশম্পায়ন?
বৈশম্পায়ন প্রায় ফুঁপিয়ে উঠে বললেন —গুরুদেব আপনার কোমর, আপনার কোমর…. আপনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না।
এবার গভীর দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকালেন ব্যাসদেব। সত্যিই তিনি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। আজ থেকে, এখন থেকে তিনি এক ন্যুব্জ বৃদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। ব্যাসদেব নিজের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বৈশম্পায়নের দিকে তাকালেন। বৈশম্পায়ন সত্যিই তখন শিশুর মত ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ব্যাসদেব একটু হেসে বললেন বৈশম্পায়ন, আমার জীবনের নতুন পর্বকে স্বাগত জানাও, অভিনন্দিত কর!
এবার আর ধৈর্য রাখতে না পেরে বৈশম্পায়ন উবু হয়ে বসে মুখ নিচু করে কাঁদতে শুরু করলেন। ব্যাসদেব তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর মৃদুকন্ঠে বললেন —- আমাকে অভিনন্দিত কর।
বৈশম্পায়ন একইভাবে কাঁদতে লাগলেন। এবার ব্যাসদেব হঠাৎ গর্জে উঠলেন—- আমি তোমাকে আদেশ করছি আমাকে অভিনন্দিত কর!
বৈশম্পায়ন অবাক হয়ে গুরুদেবের দিকে তাকালেন। তারপর নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে উঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে বললেন—- অভিনন্দন, গুরুদেব! জীবনের নতুন পর্বে প্রবেশের জন্য আপনাকে স্বাগত জানাই, সুস্বাগতম!”

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

Facebook
Twitter
LinkedIn

Privious Cover Stories

মোসলেম মিঞার কড়চা

সঞ্জীব কুমার সাহা গল্পটা রাজবিহারের। রাজবিহার জেলায় এগারোটা ব্লকের অন্যতম হল চুয়াডাঙ্গা উন্নয়ন ব্লক। কাছেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত। তো এই চুয়াডাঙ্গা ব্লকের অফিসে মোসলেম মিয়া নামে

Read More »